মালদহের দুর্গাকিঙ্কর সদন মঞ্চে মালঞ্চ নাট্যদলের নাটক। —নিজস্ব চিত্র।
নতুন করে রং করা হচ্ছে ভবন। সারানো হচ্ছে চেয়ার। নতুন আলোও বসছে। কিন্তু শব্দ প্রক্ষেপণ, আলোর কারসাজির জন্য অত্যাধুনিক সরঞ্জাম কিংবা কলকাতা, নিদেনপক্ষে শিলিগুড়ির দীনবন্ধু মঞ্চের মতো পরিকাঠামো এখনও নেই মালদহের অধিকাংশ মঞ্চে। ফলে নাটক মঞ্চস্থ করার সুষ্ঠু পরিকাঠামো না থাকায় প্রতি পদে সমস্যায় পড়ছে মালদহের নাটকের দলগুলি। মালদহের নাট্যপ্রেমীদের মধ্যে আলোচনায় যা উঠে এসেছে তা হল, অন্তত ৬০ লক্ষ টাকা ব্যয় করে সম্প্রতি শিলিগুড়ির দীনবন্ধু মঞ্চের সংস্কার করা হয়েছে। খোলনলচে বদলে ফেলা হয়েছে প্রেক্ষাগৃহের শব্দ প্রক্ষেপণ ব্যবস্থা। হাল ফেরাতে জলপাইগুড়ির সরোজেন্দ্র দেব রায়কত কলা কেন্দ্র তথা আর্ট গ্যালারিকেও বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। উত্তরবঙ্গের এই দুই শহরে সরকারি মঞ্চগুলি নিয়ে প্রশাসনিক স্তরে হস্তক্ষেপ হলেও, মালদহ কেন উপেক্ষিত থাকবে, সে প্রশ্ন তুলেছে নাট্যদলগুলি।
মালদহের সংস্কৃতিপ্রেমীদের একাংশের দাবি, শিলিগুড়ির-জলপাইগুড়ির মতো মালদহের মঞ্চগুলির আধুনিকীকরণ করতেও উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবকে উদ্যোগী হতে হবে। মন্ত্রীকে এ বিষয়ে প্রস্তাব পাঠানোর কথাও ভাবনাচিন্তা করছেন তাঁরা। মন্ত্রী গৌতমবাবু এ দিন বলেন, “উত্তরবঙ্গের অন্য শহরগুলির মতো মালদহ নিয়েও আমাদের নানা পরিকল্পনা রয়েছে। মালদহের কিছু নাটকের জনপ্রিয়তার কথা জানি। শহরের মঞ্চগুলি কী অবস্থায় রয়েছে, তা বিস্তরিত খোঁজ নেব।”
বস্তুত, নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মালদহের নাটক কিন্তু নজর কেড়েছে দেশের নাট্যপ্রেমীদের। অবহেলায় বেড়ে ওঠা মেয়ের জীবনের নানা ওঠাপড়ার সেই কাহিনি নিয়ে তৈরি ‘ফুলমতিয়া’ সমাদৃত হয়েছে মালদহের নাট্যপ্রেমীদের কাছে। ‘গম্ভীরা গম্ভীরা’ নাটক রাজ্য তো বটেই, ডাক পেয়েছে জাতীয় নাট্য উত্সবেও। ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (এনএসডি) কর্তৃপক্ষের আয়োজিত ১৭ তম ভারত রঙ্গমহোত্সবে অভিনীত হবে মালঞ্চের এই নাটক। গম্ভীরার মাধ্যমে মালদহের অন্যতম পরিচয়। মূলত একজন গম্ভীরা শিল্পীর অস্তিত্বের লড়াই উঠে এসেছে এই নাটকে। সময়ের সঙ্গে শিল্পীর তৈরি দলে ভাঙন ধরে, ভাটার টান পড়ে জনপ্রিয়তাতেও। সেই নাটক মাতিয়ে দিয়েছে সকলকেই।
গম্ভীরা-গম্ভীরার কুশীলবদের অনেকেরই আক্ষেপ, অন্যত্র মঞ্চ অত্যাধুনিক হলেও মালদহে রঙ্গমঞ্চ যেন রঙের প্রলেপ আর চেয়ার সংস্কারেই থমকে রয়েছে। কী অবস্থায় রয়েছে মালদহের প্রেক্ষাগৃহ তথা মঞ্চগুলি?
শহরের অন্যতম প্রাচীন প্রেক্ষাগৃহ হিসেবেই রবীন্দ্র ভবন পরিচিত। একসময়ে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার নাটকের দলও এই মঞ্চে অনুষ্ঠান করেছে। যদিও, ২০০৫ সাল থেকে এই মঞ্চ ব্যবহার বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। প্রায় হাজারখানেক দর্শক বসার ব্যবস্থা থাকা এই প্রেক্ষাগৃহের শব্দসংযোজনের ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। টাউন হলের মঞ্চ অপ্রশস্ত। একই রকম সমস্যা রয়েছে সানাউল্লাহ মঞ্চেও। সেখানে বড় দলের পূর্ণাঙ্গ নাটক মঞ্চস্থ করার ক্ষেত্রে সমস্যা হয় বলে নাট্যকর্মীদের একাংশের অভিযোগ। শহরের প্রাণকেন্দ্রে থাকা দুর্গাকিঙ্কর সদন মঞ্চ নিয়েও অভিযোগ শোনা যায়। নাট্যকর্মী শরদিন্দু চক্রবর্তী অভিযোগ করে বলেন, “মালদহের সংস্কৃতিপ্রেমীদের কাছে দুর্গাকিঙ্কর সদনকে এখনও পর্যন্ত শেষ ভরসা বলা যায়। তবে এই মঞ্চেও শব্দ সংযোজন ব্যবস্থার কিছু খামতি রয়েছে। সংস্কার করা মানে শুধু বহিরঙ্গে চকচকে ভাব আনা নয়, শব্দ, আলো, মঞ্চের যথাযথ সংস্কার করা। এটা প্রশাসনকে বুঝতে হবে। তবে উল্টো দিকে শহরের নাটকের চর্চা এবং জনপ্রিয়তা দুই-ই দিনদিন বাড়ছে।”
রাজ্যের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী বলেন, “টাউন হল বা দুর্গাকিঙ্কর সদনের মতো ঝাঁ চকচকে প্রেক্ষাগৃহ অন্য জেলায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে যে পরিকাঠামোগত সমস্যাগুলির কথা বলা হচ্ছে, সেগুলি সম্বন্ধে নিশ্চয়ই খোঁজ নেব।” মালদহের জেলাশাসক শরদ দ্বিবেদী জানিয়েছেন, নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে প্রশাসন সমস্যাগুলি খতিয়ে দেখবে।
অভিযোগ-পাল্টা দাবি, প্রশাসনিক আশ্বাসের টানাপড়েনের মধ্যেই গত বছরের বিভিন্ন নাটকের সাফল্যে আশার আলো দেখছেন মালদহের সংস্কৃতিপ্রেমীরা। নাট্যকর্মী অসীম ভট্টাচার্য বলেন, “শুধু আমাদের নাটক কেন, শহরের অন্য নাট্যদলের প্রযোজনাতেও মৌলিক ভাবনাচিন্তা দেখা যাচ্ছে। এবার প্রয়োজন শহরের মঞ্চগুলি নিয়েও সরকারি পদক্ষেপের।”