বাবার সঙ্গে নিজের একটি ছবি পোস্ট করেন বাবিল জানান, অনেক প্রশ্ন জমে আছে তাঁর। —ফাইল চিত্র
২০২০ সালের ২৯ এপ্রিল। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছিলেন অভিনেতা ইরফান খান। অসংখ্য অনুরাগীর কাছে তিনি এখনও জীবন্ত তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে। ‘দ্য লাঞ্চবক্স’, ‘দ্য নেমসেক’, ‘পিকু’, ‘মকবুল’-এর মতো ছবিতে ইরফানের অভিনয় কালজয়ী হয়ে রয়ে যাবে। কিন্তু সন্তানের কাছে পিতৃবিয়োগের অনুভূতির সঙ্গে তুলনীয় নয় কিছুই। ইরফানের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে মনের আগল খুলে দিলেন পুত্র বাবিল খান।
বাবিল জানান, পিতার মৃত্যুতে তিনি হারিয়েছিলেন তাঁর ‘সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু’কে। ২০২২ সালে সমাজমাধ্যমে বাবাকে নিয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেছিলেন বাবিল। অভিনয়ে পা রেখে আরও বেশি করে বাবার অনুপস্থিতি টের পেতেন বাবিল। জানালেন, ইরফান ছিলেন তাঁর আত্মার সঙ্গী। তবে তিনি ছিলেন খুব ব্যস্ত। শুটিংয়ের কাজেই অনেকটা সময় চলে যেত।
বাবাকে কাছে পেতে চেয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা করে আবেদন জানাবেন বলে ভেবেছিলেন ১০ বছরের বাবিল। ইরফানকে বলার সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান অভিনেতা। দু’জনে মিলেই চলে যান ইগতপুরীতে, ইরফানের ফার্মহাউসে।
সেখানেই ইরফান ছেলেকে বলেন সাঁতারের পোশাক পরে নিতে। বাবিলের কথায়, “আমাকে জলের মধ্যে পিছন থেকে ধরে ছিল বাবা। আমি হাত-পা দাপিয়ে চার পাশে জল ছেটাতে শুরু করি। হারিয়ে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করতে থাকি।”
এক সময় ইরফান তাঁকে জল থেকে টেনে বলেন “আজকের মতো শরীরচর্চা শেষ। আবার কাল।”
বাবিল জানান, পর পর ন’দিন একই জিনিস করেছিলেন। দশম দিনে ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে চলে যায় তাঁর। কিন্তু সে দিন তিনি আর ইতস্তত করছিলেন না বা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন না।
তাঁর কথায়, “বাবা দেখেছিল, জলের মধ্যে আমি স্বছন্দে ভাসছি। এক বার আমার মাথা একটা পাথরে ধাক্কা খেয়েছিল, বাবা তখন জল থেকে টেনে তোলে আমায়।”
ইরফান আসলে কী শেখাতে চেয়েছিলেন তাঁকে, তা তিনি বুঝেছিলেন বাবা চলে যাওয়ার পর। তিনি ফিরে যান সেই দিনে। বাবিলের কথায়, “ সূর্য ডুবে আসছে, আকাশের রং বেগনি, আমার পায়ের পাতা জলে ডুবে রয়েছে। আমি বাবাকে বলছি যে, পা দিয়ে জমি ছুঁতে পারছি না। তখন বাবার কণ্ঠ শুনেছি, আজ তুমি সমর্পণ করেছ নিজেকে, ঈশ্বরের দেখা পেয়েছ।”
বাবিল আরও বলেন, “বাবা ছিলেন রাজা, আমি ছিলাম তাঁর বিদূষক। আমি চেয়েছিলাম, তিনি যা দেখতে চেয়েছিলেন, তা যেন দেখতে পান, কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল অনেক।”
বাবার সঙ্গে হাসিমুখে নিজের একটি ছবি পোস্ট করেন বাবিল। জানান, অনেক প্রশ্ন জমে আছে তাঁর। সেই ছবির বিবরণীতে বাবার উদ্দেশে লেখেন, “ আমি তোমার হাসিটা মিস্ করি, কিন্তু জানি, এর কোনও উত্তর নেই।” শিশু বাবিলের ছবি তুলছেন ইরফান, এমন একটি স্মৃতিমেদুর ছবিও পোস্ট করেন বাবিল।
২০১৮ সালে যখন ইরফানের ক্যানসার ধরা পড়ল, বাবিল সে সময় লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা করছেন। আমেরিকায় চিকিৎসা করিয়ে ইরফান ফিরেও এসেছিলেন ২০১৯ সালে। বাবিল জানতেন, সুস্থ হয়ে উঠবেন বাবা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বাবিলের কথায়, “বাবা চলে গেল, তবু আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এক সপ্তাহ যাওয়ার পর ধাক্কাটা প্রথম লাগল আমার বুকে। আমি পুরো শেষ। তলিয়ে গেলাম, সাড় ছিল না। নিজের ঘরেই নিজেকে বন্দি করে ফেললাম টানা দেড় মাস।”
বাবা আর নেই! এই কথাটুকু অন্তর থেকে মেনে নেওয়া বাবিলের পক্ষে কখনওই সম্ভব ছিল না। তাই নিজেকে অন্য ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন তিনি। জানালেন, ইরফান প্রায়ই লম্বা শুটিংয়ে বাইরে যেতেন। বাবিলও সে ভাবেই ধরে নেন, বাবা এখন শুটিংয়ের কাজে কোথাও গিয়েছেন। শীঘ্রই ফিরবেন। কিন্তু প্রতীক্ষা আর ফুরোয় না! বাবিলের কথায়, “আমি ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করি যে, এটা একটা অনির্দিষ্ট শুটিং শিডিউল। বাবা আর ফিরবে না। বুঝলাম, আমি আমার সেরা বন্ধুকে হারিয়েছি।” যদিও বাবার স্মৃতিটুকুই বাবিলকে আনন্দে রাখে এখনও।
বাবিলের হাতে এখন নতুন কাজ। ‘যশরাজ ফিল্মস’-এর ওয়েব সিরিজ় ‘দ্য রেলওয়ে মেন’-এ তাঁকে শীঘ্রই দেখা যাবে। ১৯৮৪ সালের ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার উপর ভিত্তি করে সিরিজ়টি পরিচালনা করছেন শিব রাওয়াইল।