ইন্দ্রাণী চট্টোপাধ্যায় (প্রথম পোলিং অফিসার)
তখন ক্লাস নিচ্ছিলাম। সপ্তম পিরিয়ড। আর খানিক বাদেই বাড়ি ফিরব। ছেলে অপেক্ষা করে রয়েছে। এমন সময়ে এক সহকর্মী এসে বললেন, ‘‘তোমার নামে ভোটের চিঠি এসেছে।’’ প্রধান শিক্ষিকার কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে জানলাম, ১১ এপ্রিলের ভোটে প্রথম পোলিং অফিসার হিসেবে আমার দায়িত্ব পড়েছে আসানসোলের সেন্ট মেরি গোরেটি স্কুলে।
শুরু হল উদ্বেগ। ছেলেরও মুখ ভার। তাকে বুঝিয়েসুজিয়ে ১০ এপ্রিল ভোটের জিনসপত্র সংগ্রহের কেন্দ্র (ডিসিআরসি) সেন্ট ভিনসেন্ট স্কুলে গেলাম। সেখানে প্রচুর লোক। তার সঙ্গে সকাল থেকে তীব্র গরম। সব দেখেশুনে মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। যাই হোক, একে একে আমাদের দলের অন্য সদস্য ও প্রিসাইডিং অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ হল। ভোটের জিনসপত্র গুছিয়ে, মোবাইল নম্বর নথিভুক্ত করানোর মতো জরুরি কাজগুলি সারতে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হল। ডিসিআরসি থেকে বেরনোর সময় সূর্য এক্কেবারে মধ্য গগনে। ওই আঁচের মধ্যেই ডিসিআরসি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বেশ খানিকটা হেঁটে সেন্ট প্যাট্রিক্স স্কুলের শেষ প্রান্তে নির্দিষ্ট বাসে উঠলাম। ভোটকেন্দ্র সেন্ট মেরি গোরেটি স্কুলে ৫টি বুথ ছিল। সেখানে পৌঁছে দেখি, আমার স্কুলেরই এক শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীরও সেখানে নানা বুথে দায়িত্ব পড়েছে।
তবে ভোটকেন্দ্রে পৌঁছেই দেখি সব ক’টা ঘর অত্যন্ত অপরিষ্কার। টেবিল, চেয়ার, ব্ল্যাকবোর্ড— সব ধুলোয় ঢাকা। শুরু হল ঝাঁটার খোঁজ। কিন্তু কোথায় কী! নিজেরাই চেষ্টা করে খানিক ঝাড়পোঁছ করে নিলাম ঘরগুলো। হাত-মুখ ধুতে গিয়েও বিপত্তি। এক ফোঁটা জল নেই শৌচাগারে। সেক্টর অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমস্যার কথা জানানো হল। কিন্তু সেই যে ‘দেখছি’ বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন, সন্ধ্যার আগে তাঁর আর দেখা মিলল না। আমাদের পাশের ঘরে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান আর দোতলায় ছিলেন মহিলা পুলিশকর্মীরা। সকলের জন্যই বরাদ্দ ওই একটিমাত্র শৌচাগার। সঙ্গে আনা জল দিয়েই সকলকে কাজ চালাতে হচ্ছিল।
রাতে খাওয়ার জন্য কোনও রকমে রুটি-তড়কা জুটল। ভোটের জিনিসপত্র সব গুছিয়ে প্রস্তুতি সারতে-সারতে বেশ খানিক রাত হয়ে গেল। দু’টো বেঞ্চ জোড়া দিয়ে তৈরি হল বিছানা। ছেলের জন্য একটু মনখারাপ করছিল। চোখটা তখন সবে একটু লেগেছে। হঠাৎ বাইরে বাজখাঁই গলায় কেউ যেন জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘জল এসেছে?’’ ঘুমের দফারফা হয়ে গেল। ভোর ৪টের মধ্যে ভোটকর্মীরা উঠে পড়লাম। তখনও শৌচাগারে জল আসেনি।
ভোট শুরু হল ঠিক সময়েই। সকাল থেকেই লম্বা লাইন। এত ব্যস্ততা, যে একটু বিস্কুট খাওয়ারও সময় পাচ্ছিলাম না। সন্ধ্যা ৬টায় ভোট শেষ হল। সব জিনিসপত্র জমা দিয়ে ডিসিআরসি থেকে বেরোতে বেরোতে রাত ৯টা বেজে গেল।
বাড়ি পৌঁছতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন স্বামী। ছেলের মুখেও তখন এক গাল হাসি।
(লেখিকা আসানসোল শিশুভারতী বিদ্যামন্দির গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষিকা)