প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।
তাঁর ‘পরমাত্মার সন্তানের’ ভাবমূর্তিতে আজ বড় ধাক্কা দিল লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল। রাজনৈতিক শিবির কিছুটা হালকা চালে বলছে, এ যেন ‘পুনর্মানবো ভব’!
চূড়ান্ত মেরুকরণের পরেও তিনি ভোটের বাক্সে হিন্দুত্বের ঝড় তুলতে পারলেন না। ‘চারশো পার’ অথবা একক ভাবে ৩৭০ আসন পাওয়া দূরস্থান, দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনেক আগেই থমকে গেল রথ। তবুও তিনি, নরেন্দ্র মোদী, দুর্বল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রত্যাবর্তন করলেন তৃতীয় বারের জন্য। গত দশ বছরের যাবতীয় ক্ষোভ, বঞ্চনা, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধির ঢেউ থেকে বিজেপির ভোটকে বাঁধ দিয়ে তত দূর পর্যন্ত আটকে রাখতে পারলেন, যাতে সরকার গঠনে সমস্যা না থাকে। আজ রাতে বিজেপির সদর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী নতুন উৎসাহে আগামী পাঁচ বছরের যাত্রা অভিমুখের বিবরণ দিলেন। স্তিমিত গর্বের সঙ্গে বললেন, ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের সমস্ত দল মিলে যে আসন পায়নি, বিজেপি একাই তা পেয়েছে। তাঁর করা ভোট সংক্রান্ত প্রতিটি দর্পিত দাবির কোনওটাই যে প্রায় মেলেনি, তার কোনও উল্লেখই অবশ্য করলেন না তাঁর বক্তৃতায়।
সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছে পৌঁছতে পারছে না বিজেপি তা যখন স্পষ্ট হয়ে গেল, কংগ্রেস এবং বিরোধী শিবির থেকে আজ বিষয়টিকে মোদীর ‘নৈতিক পরাজয়’ হিসাবে বর্ণনা করা শুরু করে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী তো এ কথাও বলেন, “আজকের ফলাফলেই প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে দেশবাসী আর মোদীকে প্রধানমন্ত্রী দেখতে চাইছেন না। তাঁর সরে দাঁড়ানো উচিত।” বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডা অবশ্য এ দিন রাতে প্রথমেই স্পষ্ট করে দেন, আগামী দিনে মোদীর কোনও বিকল্প নেই। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবেই সামনে রেখে এগোনো হবে। আর মোদী নিজে এই ধাক্কাকে কার্যত উল্টে দিয়ে বলেন, বাষট্টির পর এমন ঘটনা আর ঘটেনি, যে একই সরকার পর পর তিন বার ক্ষমতায় এসেছে। এই ‘ঐতিহাসিক’ জয়ের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর দায়িত্ব এবং কর্তব্যকে বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেছেন মোদী। জানিয়েছেন, দেশের আরও বেশি করে সেবা করার উৎসাহ এবং প্রেরণা তিনি আজকের ফলাফলেই পেয়ে গিয়েছেন। দেশবাসীর উদ্দেশে মোদীর প্রতিশ্রুতি, “আপনারা দশ ঘণ্টা কাজ করলে মোদী আঠারো ঘণ্টা কাজ করবে। আপনারা দু’পা এগোলে মোদী দশ পা এগোবে। এটা মোদীর গ্যারান্টি।” বুধবার সকালেই বৈঠকে বসছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে সরকার গঠনের দাবি জানানোর প্রক্রিয়াও শুরু হবে কালই। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে জানানো হয়েছে, ৯ তারিখের মধ্যেই নতুন সরকারের শপথের বন্দোবস্ত করা হবে। এ জন্য আপাতত রাষ্ট্রপতি ভবনে বাইরের লোকেদের প্রবেশ বন্ধ করা হল।
রাজনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, বিজেপি আজ যে আসন পেয়েছে, পর পর দু’বার জিতে আসার পর তৃতীয় বার কোনও রাজনৈতিক দলের সেটা পাওয়া কম কথা নয়। কিন্তু মোদীর আকাশ ছোঁয়া আত্মবিশ্বাস, দাবি এবং প্রতিপক্ষকে যথেচ্ছ তাচ্ছিল্য করার কারণেই আজ এই সংখ্যাকে যথেষ্ট কম বলে মনে হচ্ছে। পাশাপাশি ‘চারশো পার’-এর স্লোগান যে সমাজের দলিত, পিছিয়ে পড়া, দুর্বল অংশের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি করেছিল, সেটাও মনে করা হচ্ছে। এই ধারণা বিরোধীরা তাঁদের মধ্যে সফল ভাবে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন যে, মোদী এই বিপুল জনাদেশ চাইছেন বি আর অম্বেদকরের সংবিধান বদলে দেওয়ার জন্য। বহু সভায়, ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি তো কলা খাইনি’ প্রবচনের ধাঁচে মোদীকে বলতে শোনা গিয়েছে, “বাবা সাহেব অম্বেদকরের করা সংবিধান স্বয়ং অম্বেদকরও এসে বদলাতে পারবেন না, আমি তো নয়ই।” কিন্তু তাঁর এই কথাকে বিশ্বাস করেনি উত্তর ভারত।
তবে রাজনৈতিক শিবির এটাও মনে করছে, মোদী যদি এত উঁচু তারে গোড়া থেকেই দলের লক্ষ্যমাত্রাকে বেঁধে না দিতেন, আজ এই সংখ্যায় পৌঁছনোও সম্ভব ছিল না। দেশজুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর ক্ষোভ, বাজারে আগুন, ঘরে ঘরে বেকারত্বের আঁচ মোদী টের পাননি এমন নয়। জানতেন লড়াইটা কঠিন। তাই একটা কৃত্রিম হাওয়া তিনি তৈরি করেছিলেন, যাতে তিনশো সত্তর বললে (বিজেপি একক ভাবে) সরকার গড়ার জায়গায় পৌঁছয় তাঁর দল। অবশ্য কার্য ক্ষেত্রে তা হল না, এনডিএ-র শরিকদের সহায়তা ছাড়া তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আজ অচল।
মোদীর ব্যক্তিত্বের সঙ্গেই যে ভাবে একক রাজনৈতিক প্রদর্শনীর বিষয়টি জড়িয়ে রয়েছে, তাতে শরিকের কথায় নীতি নির্ধারণ করা বা কার্যত ওঠবোস করা, তাঁর কতটা ধাতে সইবে— তা নিয়ে সন্দিহান মোদী বিশেষজ্ঞরাই। গুজরাতে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে গত কাল পর্যন্ত, দীর্ঘ দু’দশকেরও বেশি সময় তিনিই ছিলেন তাঁর সরকারের শেষ কথা, সর্বেসর্বা। কিন্তু আজ বক্তৃতায় যতই শৌর্য দেখান না কেন, টিডিপি বা জেডি(ইউ)-এর মতো শরিকদের সর্বদা সর্ব ক্ষেত্রে সংসদের ভিতরে ও বাইরে অগ্রাধিকার দিয়ে চলতে হবে তাঁকে।
আরও একটি বিষয় মোদীকে ভারাক্রান্ত করবে বলে মনে করা হচ্ছে। তিনি এই ভোটে শুধুমাত্র মেরুকরণের রাজনীতির উপরেই জোর দিয়েছিলেন বলে মনে করা হচ্ছে। এ’টি তাঁর ব্রহ্মাস্ত্র, যা অতি ব্যবহারে ধার হারাতে পারে, এটা বোঝারও অবকাশ তাঁর ছিল না। খাস অযোধ্যা যে কেন্দ্রে, সেই ফৈজ়াবাদে বিজেপি প্রার্থীর হেরে যাওয়া তার প্রমাণ। উত্তরপ্রদেশে বিজেপির মুখ থুবড়ে পড়া তার প্রমাণ। সব চেয়ে বড় কথা নিজের কেন্দ্র বারাণসীতে হিন্দু ভোটারদের কাছে অবহেলা পাওয়াটাও তার প্রমাণ। ২০১৪ ও ২০১৯-এর পরে মোদী তৃতীয় বার বারাণসী থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন। ২০১৪-য় তার জয়ের ব্যবধান ছিল প্রায় ৩ লক্ষ ৭০ হাজার। ২০১৯-এ তা বেড়ে হয় প্রায় ৪ লক্ষ ৭৯ হাজার। এ বার রাম মন্দির এবং হিন্দুত্বের গর্বে গর্বিত মোদী জয়ের ব্যবধানের লক্ষ্যমাত্রা রেখেছিলেন সাত লাখ। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল সেটা ১ লাখ ৫২ হাজার ৫১৩ ভোটে! আজ একই সঙ্গে এই প্রশ্নও উঠছে, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নিজস্ব রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা ভেবে কোনও অন্তর্ঘাত করলেন কি না বিজেপির লোকসভা অভিযানে।
আজ অবশ্য তাঁর বক্তৃতায় অস্বস্তির এই সব ছায়াগুলিকে একেবারেই এড়িয়ে গিয়েছেন মোদী। বরং বলেছেন, “বিকশিত ভারত গড়ার জন্য মেহনত থামানোর কোনও সম্ভাবনা নেই। ছ’দশক পরে দেশবাসী এই ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে। ইন্ডিয়ার সব দল মিলিয়ে যে আসন পেয়েছে, বিজেপি একা তার চেয়ে বেশি। দেশবাসীর বিশ্বাসের এই অটুট সম্পর্ক নতুন শক্তিতে আমাদের কাজ করার শক্তি দেবে।”