প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল ছবি।
পঞ্জাবের হোসিয়ারপুরে এসে আজ থামল দেশভর নরেন্দ্র মোদীর ঝোড়ো প্রচার। গত ছিয়াত্তর দিনে (১৬ মার্চ নির্বাচন কমিশন ভোট ঘোষণা করে) ২০৬টি জনসভা করেছেন তিনি। ৮০টি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সংবাদমাধ্যমকে।
প্রাথমিক ভাবে, তাঁর সরকারের গত পাঁচ বছরের কাজের খতিয়ান দিয়ে প্রচার শুরু করেছিলেন মোদী। কিন্তু নির্বাচনের দু’টি পর্বে ভোটদানের হার গত বারের তুলনায় কমে যাওয়ায় বক্তব্যের অভিমুখ বদলে ফেলেন। হেঁটেছেন চূড়ান্ত মেরুকরণের রাস্তায়। প্রত্যেক দিন গড়ে তিনটি সভায় তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, কংগ্রেস তথা ‘ইন্ডিয়া’ জোট তফসিলি জাতি, জনজাতি, দলিত, ওবিসি-র সংরক্ষণ কেটে মুসলমান তথা নিজেদের ভোটব্যাঙ্ককে দিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে আজ গোটা বিষয়টি নিয়ে আক্রমণ করেছেন মোদীকে। পরিসংখ্যান দিয়ে তাঁর বক্তব্য, “প্রধানমন্ত্রী ৪২১ বার মন্দির-মসজিদ নিয়ে কথা বলেছেন। ২২৪ বার মুসলমান, পাকিস্তান, সংখ্যালঘু প্রসঙ্গে সরব হয়েছেন। আর তিনি এতটাই আত্মমুগ্ধ যে প্রচারের শেষ ১৫ দিনে বক্তৃতায় ৭৫৮ বার মোদী শব্দটিই ব্যবহার করেছেন!”
২০১৯ সালে নিজের রেকর্ডই এ বার ভেঙেছেন মোদী। সে বারে প্রচারের সময় ছিল ৬৮ দিন। মোদী ১৪৫টি জনসভা করেছিলেন। এই নিয়ে খড়্গের কাছে প্রতিক্রিয়া চাওয়ায় তিনি বলেন, “মোদী সব রেকর্ড ভেঙে দিতে পারেন, কিন্তু এত কথা কেন বলছেন? ২০১৪ সালে উনি দেশে অনেক ঘুরেছিলেন। ২০১৯ সালে তাঁকে এত ঘুরতে দেখা যায়নি। এখন এত উতলা কেন?” কংগ্রেস সভাপতির ব্যাখ্যা, “বোঝা যাচ্ছে ডাল মে কুছ কালা হ্যায়! এ বারে ওরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে না। আর তাই এক শহর থেকে অন্য শহরে দৌড়েছেন ভয়ের চোটে।”
রাজনৈতিক শিবিরের মতে, এ বারের ভোটে উগ্র জাতীয়তাবাদ, সার্জিকাল স্ট্রাইকের শৌর্য, হিন্দুত্বের নব তরঙ্গ ছিল না বলে বিজেপি অভ্যন্তরীণ শিবির কিছুটা শঙ্কায় ছিল। তাই প্রবীণ মোদী মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, কৃষক অসন্তোষের জোয়াল কাঁধে নিয়ে মরিয়া প্রচার করে গিয়েছেন। রামমন্দির নির্মাণ ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলবে বলে বিজেপি নেতৃত্বের যে হিসাব ছিল, তা মেলেনি। কারণ, রামমন্দির উদ্বোধন প্রচার শুরুর অনেকটা আগেই হয়ে গিয়েছিল। তবু প্রায় প্রতিটি প্রচারে রামমন্দিরের প্রসঙ্গ এনেছেন মোদী, কিছুটা নেতিবাচক ভাবেই। বলেছেন, ‘কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়ার জোট সঙ্গীরা মন্দির উদ্বোধনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে ভারতাত্মার অপমান করেছেন।’
প্রচারের মাঝপথে কংগ্রেসের ন্যায়পত্র তথা ইস্তাহার প্রকাশিত হওয়ার পর মোদী কংগ্রেসের ভাষ্যের প্রতিক্রিয়া বারবার দিয়েছেন। রাহুল গান্ধী, খড়্গের মতো নেতারা বলছেন, তাঁরা নিজেরা না যতটা ন্যায়পত্রের প্রচার করেছেন, তার তুলনায় বেশি করেছেন মোদী নিজে।
তবে কংগ্রেস দু’টি লোপ্পা বল দিয়েছে মোদীকে। প্রচার যখন তুঙ্গে, তখন আমেরিকার উত্তরাধিকার করের প্রশংসা করেন কংগ্রেসের ওভারসিজ় শাখার তৎকালীন কর্তা স্যাম পিত্রোদা। কংগ্রেস তা সামলাতে না সামলাতেই মণিশঙ্কর আইয়ার বলে বসেন, পাকিস্তানের পরমাণু বোমা থেকে সতর্ক থাকার কথা। ফলে এক দিকে মোদী বলেছেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে গরিব মানুষের সামান্য সঞ্চয়ের অর্ধেক কেড়ে নিজের ভোটব্যাঙ্কে বিলিয়ে দেবে। পাশাপাশি পাকিস্তান প্রসঙ্গে মিইয়ে যাওয়া জাতীয়তাবাদকে কিছুটা উসকে দেন। ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চ ক্ষমতায় এলে মেয়েদের মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেওয়ার কথাও বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে।
প্রচারের শেষ পর্বে রূপান্তর দেখা গিয়েছে তাঁর। জনসভায় নিজেকে জনতার সেবক বললেও কিছু সাক্ষাৎকারে নিজেকে 'পরমাত্মার সন্তান' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি বলেছেন, ২০৪৭ সালেও তিনি দেশের কাজে নিয়োজিত থাকবেন! এই ‘ঐশ্বরিক’ ভাবমূর্তি তাঁর দীর্ঘ আগ্রাসী প্রচারের উপসংহারে সুকৌশলে ব্যবহার করা হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। আর তারই সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে শেষ পর্বের ভোটের দিন, তিনি ক্যামেরার সামনে বিবেকানন্দ রক-এ ধ্যানমগ্ন থেকে রাজনৈতিক বার্তা দেবেন বলে দাবি করছেন বিরোধীরা।