মহুয়া মৈত্র। —ফাইল ছবি।
গনগনে দুপুরে রাস্তার ধারে আমগাছের ছায়ায় জটলা করছিলেন জনা পাঁচেক। হাতে-পায়ে কাদা-মাটি, সকলেই চাষি।
“কি চাচা, এ বার ভোটে কী হবে?”
প্রশ্ন শুনে একটু থমকে যান সকলেই। তার পর হাতের পিঠে কপালের ঘাম মুছে কাঁচাপাকা দাড়ির বছর পঞ্চাশের লোকটি বলেন, “এ বার আর তৃণমূলকে ভোট দেব না ভাবছি।” তাঁর মুখের দিকে অবাক হয়ে চান বাকিরা। কালচে প্লাস্টিকের বোতল থেকে জল গলায় ঢেলে প্রবীণ বলেন, “গ্রেফতারি বাঁচাতে মহুয়া মৈত্র তো জেতার পর বিজেপিতে চলে যাবেন শুনছি। দেখছেন না, সিবিআই-ইডি ওঁকে আর ডাকছে না!”
নদিয়ার কৃষ্ণনগর কেন্দ্রের পলাশিপাড়ায় এই ধোপট্ট এলাকা তৃণমূলের গড়। হারিয়ে যেতে বসা লালঝান্ডা অনেক দিন পরে এ বার এখানে উঁকিঝুঁকি মারছে। পঞ্চায়েত ভোটের আগে থেকেই সিপিএম যে ‘গোকুলে বাড়ছে’ তা বোঝা যাচ্ছিল সংখ্যালঘু এলাকাগুলিতে নতুন করে লালঝান্ডা উড়তে দেখেই। পলাশিপাড়া কেন্দ্রের প্রাক্তন বিধায়ক এস এম সাদিই এ বার সিপিএমের প্রার্থী। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তিনি যত ছুটে বেড়াচ্ছেন, ততই যেন তৃণমূল নেতাদের মুখ শুকোচ্ছে। কারণ সিপিএম যত সংখ্যালঘু ভোটে ভাগ বসাবে, মহুয়ার লড়াই তত কঠিন হবে।
এর মধ্যে ‘মহুয়া জিতে বিজেপিতে চলে যাবে’ ধরনের ফিসফিস প্রচারে বিরোধীদের পাশাপাশি তৃণমূলের মহুয়া-বিদ্বেষীদেরও হাত আছে কি না, সেটা গবেষণার বিষয়। তবে বিজেপি ভীতি এখনও সংখ্যালঘুদের মনে স্পষ্ট। বিশেষ করে সিএএ বলবৎ হওয়ার পরে তা আরও বেশি করে চেপে বসেছে।
কথাটা শুনেই ফুঁসে ওঠেন বছর তিরিশের এক যুবক, “রাখেন তো, ও সব সিপিএমের প্রচার। দেখেন না, মহুয়া কেমন সংসদে মোদীকে আক্রমণ করে?” পাশ থেকে ফুট কাটেন এক প্রৌঢ়, “শুনছি নাকি সংসদে প্রশ্ন করে লিপিস্টিক-জুতো এ সব ঘুষ নেয়...।” অর্থাৎ সংসদে ঘুষের বিনিময়ে প্রশ্ন তোলার অভিযোগে মহুয়ার বহিষ্কারের প্রসঙ্গটা এসেই পড়ে। কিন্তু যুবক হাঁকিয়ে দেন— “যত বাজে কথা। মোদী-আদানিদের বিরুদ্ধে দিদির মুখ বন্ধ করতেই এ সব বলছে!”
এঁরা সকলেই সংখ্যালঘু। বোঝা যায়— চাপড়া, পলাশিপাড়া, কালীগঞ্জ ও নাকাশিপাড়া বিধানসভা কেন্দ্র এবং আশপাশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সংখ্যালঘুরা কিছুটা বিভ্রান্ত। গত পঞ্চায়েত ভোটে এই এলাকাগুলিতে অনেকটাই ভোট বাড়িয়েছে বাম-কংগ্রেস, তাদের মিলিত ভোট প্রায় ২৭ শতাংশ। ডাংনার বাসিন্দা, বছর চল্লিশের সিরাজুল শেখ অবশ্য মাথা নেড়ে বলছেন, “দুটো আলাদা ভোট। আমিই তো পঞ্চায়েতে সিপিএমকে ভোট দিয়েছি, এ বার বিজেপিকে হারাতে বুকে পাথর চাপা দিয়ে তৃণমূলকে দেব।”
প্রায় ৬৮ শতাংশ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা চাপড়ার বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া ডাংনা গ্রামে কিন্তু মিশ্র বসতি। ঢোকার মুখে রাস্তার পাশে অশ্বত্থ গাছের নীচে নানাবয়সির জটলা। মোটরবাইকের পিছনে দুধের ড্রাম বাঁধা, মাটিতে এক পা রেখে বসা এক ঘোষবাবু প্রশ্ন তোলেন, “বিজেপি কী দোষ করল? কেন্দ্রের যত প্রকল্প, তার একটাও কি হিন্দু-মুসলিমের জন্য আলাদা? এরা তো এক দিকে লক্ষ্মীর ভান্ডার দিচ্ছে, আর এক দিকে চাকরি বেচে দিচ্ছে!” সিরাজুল শেখ ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, “তোমার ঘরেই তো বৌ, মেয়ে আর বৌমা মিলিয়ে লক্ষ্মীর ভান্ডারের চার হাজার টাকা ঢুকছে!”
বিপুল দুর্নীতির অভিযোগ বনাম লক্ষ্মীর ভান্ডারের খয়রাতি— কোনটাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন ভোটারেরা, তার উপরেই তৃণমূলের ভোটভাগ্য অনেকটা নির্ভর করছে। তেহট্টের হাউলিয়া মোড় থেকে করিমপুরের দিকে যেতে রাস্তার ডান দিকে ছোট্ট চায়ের দোকানের মালিক কিছুটা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নাড়েন, “দূর দূর, দুর্নীতি নিয়ে কেউ ভাবে নাকি, হাতে-গরম টাকার গুরুত্ব মানুষের কাছে অনেক বেশি।” যদিও শহুরে মধ্যবিত্ত, যাঁরা সরকারি অনুদানের উপর তত নির্ভরশীল নন বরং চাকরির মুখাপেক্ষী, তাঁদের চিন্তা বিপরীত খাতে বইতেই পারে।
এই কেন্দ্রের একমাত্র পুরসভা, নদিয়ার জেলাসদর কৃষ্ণনগর বরাবরই বিজেপির দিকে ঝুঁকে। এক সময়ে বিজেপির সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় যখন দৌড়ে তৃতীয় হয়েছেন, তখনও একমাত্র এই শহর তাঁকে লিড দিয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনে কৃষ্ণনগর উত্তর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রায় ৫৩ হাজার ভোটে তৃণমূলের চেয়ে এগিয়ে ছিল বিজেপি, তার মধ্যে শুধু কৃষ্ণনগর শহরই প্রায় ২৮ হাজার ভোটে লিড দেয়। গত বিধানসভা ভোটেও প্রায় ৩৫ হাজার ভোটে জেতেন বিজেপির মুকুল রায়।
তবে এ বার অন্য একটি অঙ্ক রয়েছে। কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের সদস্য অমৃতা রায় এ বারে বিজেপির প্রার্থী। এই পরিবারের প্রতি কৃষ্ণনাগরিকদের একাংশের যেমন আনুগত্য আছে, একাংশের অনীহাও আছে। তার উপর প্রার্থীর পরিচয় হিসাবে ‘রাজমাতা’ শব্দ ব্যবহার এবং পলাশির যুদ্ধে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের ভূমিকা নিয়েও জলঘোলা হয়েছে। বিজেপির যে নেতারা মহুয়াকে হারাতে ‘দমদার’ প্রার্থী চেয়েছিলেন, তাঁরা মিটিং-মিছিলে যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু কিঞ্চিৎ মুষড়ে রয়েছেন।
প্রচারের দৌড়েও বয়স্ক প্রতিদ্বন্দ্বীকে পিছনে ফেলছেন মহুয়া। ফলে বিভিন্ন শক্ত ঘাঁটিতেও তাঁদের ভোট কতটা অক্ষুণ্ণ থাকবে সে ব্যাপারে বিজেপি নেতারা আদৌ নিশ্চিত নন। চাপড়ার কলিঙ্গ গ্রাম পঞ্চায়েতের বহিরগাছি-বাগমারা এলাকা বিজেপির তালুক বলে পরিচিত। চায়ের দোকানি অষ্টম দাস কিন্তু বলছেন, “বিজেপির ভোটার আছে বটে, কিন্তু নেতা কই?”
এই বাজারে দু’-একটা খুচরো চোরকাঁটাও রয়েছে। যেমন, আইএসএফ প্রার্থী দেওয়ায় সংখ্যালঘু ভোট ভাগের চিন্তায় চাপড়ার তৃণমূল। আবার তেহট্টের এক মতুয়া ভক্ত নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ার ফলে কিছুটা উদ্বিগ্ন বিজেপি।
এ সবের সঙ্গে রয়েছে মহুয়ার ‘দুর্ব্যবহার’। তা নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের এক অংশ বিরক্ত। তেহট্টের এক জেলা পরিষদ সদস্যের মতো ভোটের ময়দান থেকে একেবারে উধাও না হয়ে গেলেও অনেকেই ‘কার্যত নিষ্ক্রিয়’।
এমনই সব অঙ্কে দুলছে কৃষ্ণনগরের এ বারের ভোট।