প্রবন্ধ ১

সাংসদ ট্রেনিং পাশ?

জনপ্রতিনিধিত্ব কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টার পেশা। আর পাঁচটা কাজ করে সাইডে দেশের দশের ভাল করা যায় না। সেটা কি আমরা জানি? ইন্দ্রজিত্‌ রায়।কলেজে পড়ার সময় আমিও সিনেমার হিরো হতে চাইতাম। না, মুম্বই পাড়ি দিতে চাইনি, বাংলার সিনেমারই হিরো হতে পারি মনে মনে ভাবতাম। বাংলায় হিরোর তখন বেশ মন্দা। মহানায়ক চলে গেছেন এক দশক হল। তাপস পাল পড়তি, প্রসেনজিত্‌ উঠতি, বাকিটা ফাঁকা। অতএব, আয়নাকে রোজ জিজ্ঞেস করতাম, আমিই কি নতুন হিরো? স্কুল কলেজে বেশ কিছু নাটক করেছি, এমনকী আজকের বিখ্যাত কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক মঞ্চে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৫২
Share:

কলেজে পড়ার সময় আমিও সিনেমার হিরো হতে চাইতাম। না, মুম্বই পাড়ি দিতে চাইনি, বাংলার সিনেমারই হিরো হতে পারি মনে মনে ভাবতাম। বাংলায় হিরোর তখন বেশ মন্দা। মহানায়ক চলে গেছেন এক দশক হল। তাপস পাল পড়তি, প্রসেনজিত্‌ উঠতি, বাকিটা ফাঁকা। অতএব, আয়নাকে রোজ জিজ্ঞেস করতাম, আমিই কি নতুন হিরো? স্কুল কলেজে বেশ কিছু নাটক করেছি, এমনকী আজকের বিখ্যাত কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক মঞ্চে। এই সম্বলটুকু নিয়ে নানান দরজায় কড়া নাড়তে বেরিয়ে পড়লাম। কোনও দরজাই খুলল না।

Advertisement

সে দিন এক প্রবীণ পরিচালক একটা শিক্ষা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তুমি তো এখন একটা নামজাদা ইনস্টিটিউটে অঙ্ক নিয়ে পড়াশোনা করছ, এর মধ্যে কি সিনেমার কাজ করার সময় পাবে? হিরো হওয়ার জন্যে তো ট্রেনিং দরকার। যদি লেগে থাকতে পার, যদি পড়াশোনা করেও হাতে সময় থাকে, তা হলে বরং একটা গ্রুপ থিয়েটারে যোগ দাও। কয়েক বছর অভিনয় শিখে আমার কাছে আবার এসো। পরামর্শটা তেতো শোনালেও যে খাঁটি, তা সে দিন মস্তিষ্কে ঢুকেছিল। অঙ্ক নিয়ে পড়াশোনা করে, কলেজ জীবনের হস্টেলে আরও চোদ্দোটা মজা মেরে তখন আমার থিয়েটার করা হয়নি। হিরো আর আমি হতে পারিনি!

শুধু বাংলা সিনেমার হিরো হওয়া নয়, আরও বেশ কিছু পেশা সম্বন্ধে আমাদের ধারণাটা বেশ অস্বচ্ছ। যেমন, আমরা বাঙালিরা সবাই কবি ও সাহিত্যিক। মনে মনে ভাবি, ছন্দ মেলানোর পাটও যখন অনেক দিন হল চুকেবুকে গেছে, তা হলে তো কবি হওয়া ভারী সোজা। পুজো প্যান্ডেলের দেওয়াল পত্রিকায় দু-চারটে কবিতা তো ছাপা হয়েছেই, আমি তো এ বার সাহিত্যচর্চা করলেই পারি। কিংবা ব্যান্ডের গান, সে তো আমাদের রকের আড্ডারই প্রতিফলন।

Advertisement

এ রকমই আর এক পেশা (নাকি নেশা?) হল সাংসদ হওয়া। আমরা অনেকেই ভাবি, যে কেউ চাইলেই সাংসদ বা বিধায়ক হতে পারেন। বিশেষ করে সেলেব্রিটিরা। লোকে চেনে, তাই জনপ্রতিনিধি হওয়াই যায় এটাই এখন প্রচলিত ধারণা। তারকাদেরও, আমাদেরও। সাংসদ হওয়াটা যে ঠিক কী দাবি করে তা আমাদের তারকারাও অনেকেই হয়তো ঠিক বোঝেন না, অথবা বুঝেও তা অস্বীকার করেন। হয়তো বা ভাবেন, বছরের ৫২টা সপ্তাহের মধ্যে সংসদের অধিবেশন তো চলে মাত্র তিন বার, সাকুল্যে ২৬ সপ্তাহও হবে না। আর সব সেশনের সব দিনই যে যেতেই হবে, এমন দাবিও তো কেউ করছে না। অতএব ম্যানেজ হয়ে যাবে। কিছুটা আমার অঙ্ক করতে করতে হিরো হবার মতোই। আর আমরা ভোটাররাও হয়তো ভাবি, ওঁরা অন্য ক্ষেত্রে সফল, অতএব সাংসদ হিসেবেও নিশ্চয় সফল হবেন! কোন দল কত আসন পেল, সেটাই আমাদের মুগ্ধতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কোনও বিশেষ তারকার সাংসদ হিসেবে (অ)দক্ষতা ও সময়ের (অ)প্রতুলতা নিয়ে আমরা মোটেই মাথা ঘামাই না। তার ওপর, আমরা আশা করি ওঁরা নিজেদের ইমেজ বজায় রাখতে কোনও দুর্নীতিতে জড়াবেন না।

তারকা এবং আমরা ভোটাররা কি আসলে ভাবের ঘরে চুরি করছি না? আমরা ভুলে গেছি যে, সাংসদ হওয়াটা একটা পুরোদস্তুর পেশা। এবং যে সে পেশা নয়, খুবই গুরুত্বের ও সম্মানের পেশা। অন্য অনেক পেশার চেয়ে এই পেশার দাবি অনেক বেশি রাতদিন দেশের কোনও না কোনও বিষয়ে মাথা ঘামাতে হয়। তাই কোনও বড় কোম্পানির সিইও যেমন সিনেমার হিরো হতে পারেন না, তেমনই ঠিকঠাক সাংসদ হলে অন্য কাজ করা প্রায় অসম্ভব। আজকালকার ছুটে চলার জীবনে আমার মতো হরিপদ কেরানিরও মাঝেমধ্যে দিনে আটচল্লিশ ঘণ্টা পেলে ভারী ভাল হত। তা হলে তারকাদের কথা ভাবুন।

মনে রাখা ভাল, সংসদে যে ছয় মাস যেতে হয় না, সেই সময় কিন্তু সাংসদদের বেকার বসে থাকার কথা নয়। সংসদের মূল কাজ আইন প্রণয়ন তার জন্য প্রচুর চিন্তাভাবনা, গবেষণা করতে হয়। আর তা ছাড়া নিজের কেন্দ্রের সমস্যার মোকাবিলা তো বছরভর থাকবেই। যেমন হিরো হতে গেলে অভিনয়ের শিক্ষা লাগে, তেমনই সাংসদ হতে গেলেও ট্রেনিং দরকার। কথাটা যে আমরা একেবারেই বুঝি না, তা কিন্তু নয়। আমাদের পাড়ায় পাড়ায় অনেক রাজনৈতিক দাদা-কাকা আছেন, যাঁরা চব্বিশ ঘণ্টা পার্টির কাজ করেন। উপরের সমস্যাগুলো তাঁদের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো। প্রথমত, পেশা হিসেবে তাঁরা হয়তো স্কুলের শিক্ষক বা অফিসের কেরানি। কিন্তু তা নেহাতই নাম কা ওয়াস্তে, পার্টির কর্মী হিসেবেই তাঁদের সারাটা দিন কাটে। তাঁদের এই ‘পার্টি-করা’টা স্কুল বা অফিস মেনে নেন। তবে, সারা দিন পার্টির পেছনে দিলেও পার্টি কিন্তু এই সব কর্মীদের কোনও শিক্ষা বা ট্রেনিং দেবার ব্যবস্থা করে না। আমাদের গণতন্ত্রে সাংসদ বা বিধায়ক বা নিদেনপক্ষে পুরসভার সদস্য হতে গেলেও যে পুরোদস্তুর যোগ্যতা ও শিক্ষা লাগে, সেটাই দেশের কোনও দল স্বীকার করে না।

পশ্চিমের দেশগুলিতে ছবিটা পুরোই আলাদা। রাজনীতি পুরোদস্তুর এক পেশা। কর্মীদের, বিশেষত যাঁরা ভবিষ্যতে নেতা বা সাংসদ হতে চান, তাঁদের সর্বক্ষণ নানাবিধ ট্রেনিং দেওয়া হয়। (উদাহরণ হিসেবে বিলেতের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের ওয়েবসাইট কনজারভেটিভস ডট কম দেখুন)। বিলেতের বহু স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা বা সাংসদই উচ্চশিক্ষিত। প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও দর্শনশাস্ত্রের স্নাতক। সংসদে অক্সফোর্ড-কেমব্রিজের ডিগ্রির ছড়াছড়ি। অনেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পিএইচ ডি পর্যন্ত করেছেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই তাই এঁরা সাংসদ হবার প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও দক্ষতা লাভ করেন। আমেরিকাও পিছিয়ে নেই। বারাক ওবামা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের জার্নাল হার্ভার্ড ল’ রিভিউ-এর সম্পাদক ছিলেন।

তবে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় তো সারা জীবন কাটে না। সাংসদদের নিয়মিত কোর্স করতে, ট্রেনিং নিতে হয় বইকী। বিলেতে বছরে খান কুড়ি সপ্তাহ সংসদের সেশন বন্ধ থাকে। সেই সময় সাংসদদের কাজ বাড়ে বই কমে না। এই সময় কী কী কাজ তাঁদের করতে হয় এবং বস্তুত তাঁরা করেন, তার খতিয়ান পার্লামেন্টের ওয়েবসাইট থেকে মিলবে। যাঁরা ভবিষ্যতে সাংসদ হতে চান তাঁরাও এই সব কোর্স নিতে পারেন। সংসদের কাজ ও ট্রেনিংয়ের বাইরে সব সাংসদই নিজেরা নিজেদের এলাকার নানাবিধ প্রকল্পে জড়িয়ে থাকেন, এলাকার মানুষের সমস্যার সমাধানে ভূমিকা নেন। এ ছাড়া রয়েছে নিজের দলের (ক্ষমতাসীন ও বিরোধী, যে দলই হোক না কেন) সংসদ সংক্রান্ত বিভিন্ন কমিটির কাজ। মোদ্দা কথা হল, এত সব কাজে তাঁদের এতই ব্যস্ত থাকতে হয় যে, এর বাইরে কোনও ফুলটাইম-সাংসদের অন্য কোনও পেশার কথা ভাবাই দুষ্কর। সাংসদও হব আবার সঙ্গে সঙ্গে সিনেমাও করব এ অসম্ভব।

এ সব অবশ্য অন্য পৃথিবীর গল্প।

ইংল্যান্ডে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement