সম্পাদকীয় ১

সংস্কার কেন জরুরি

বুদ্ধিমান যাঁহারা, তাঁহাদের জন্য নাকি ইশারাই যথেষ্ট। কতখানি ইশারা যথেষ্ট, তাহা অবশ্য স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষ নহে। যেমন, দেশটির নাম চিন হইলে পার্টির শীর্ষনেতার ঈষত্‌ হাস্যই বুদ্ধিমানদের নিকট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহিত কূটনৈতিক বরফ গলাইবার সবুজ সংকেত রূপে প্রতিভাত হইতে পারে। কথিত আছে, হইয়াছিল। কিন্তু ভারত অন্য দেশ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share:

বুদ্ধিমান যাঁহারা, তাঁহাদের জন্য নাকি ইশারাই যথেষ্ট। কতখানি ইশারা যথেষ্ট, তাহা অবশ্য স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষ নহে। যেমন, দেশটির নাম চিন হইলে পার্টির শীর্ষনেতার ঈষত্‌ হাস্যই বুদ্ধিমানদের নিকট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহিত কূটনৈতিক বরফ গলাইবার সবুজ সংকেত রূপে প্রতিভাত হইতে পারে। কথিত আছে, হইয়াছিল। কিন্তু ভারত অন্য দেশ। এখানে অর্থমন্ত্রী যদি বলেন, ‘যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি আর্থিক ক্ষতির কারণে বন্ধ হইয়া যাইবার মুখে দাঁড়াইয়া আছে, সরকার যথার্থ সময়ে সেগুলির বিলগ্নিকরণের কথা ভাবিবে’, তবে তাহাকে সংস্কারের অশ্বমেধ ঘোড়ার যাত্রারম্ভের ইঙ্গিত হিসাবে মানিয়া লইতে কাহারও দ্বিধা থাকিতে পারে। হয়তো ইহা সত্যই সংস্কারের পথে জয়যাত্রার সূচনামুহূর্ত, হয়তো সত্যই অর্থমন্ত্রী রাখিয়া-ঢাকিয়া বলিয়াছেন। কিন্তু, যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিপুল ক্ষতিতে চলিতেছে, শুধু সেগুলির বিলগ্নিকরণ, তাহাও আবার ‘যথার্থ সময়ে’— যাঁহার নিকট ভারতের মার্গারেট থ্যাচার হইয়া উঠিবার প্রত্যাশা, তাঁহার সরকারের তরফে এমন দ্বিধাতাড়িত বার্তা কিঞ্চিত্‌ বিষাদজনক। এই বার্তায় বড় জোর আর্থিক তাগিদের ছাপ রহিয়াছে, সংস্কারের দার্শনিক গুরুত্বের অনুরণন নাই। জেটলির এই বার্তায় ‘তৃতীয় ইউপিএ’-র অবসান ঘটিল। বিলগ্নিকরণের নাম শুনিলেই জিভ কাটিবার অভ্যাসটিও সম্ভবত গেল। কিন্তু তাহা যথেষ্ট নহে। সংস্কারের পথে হাঁটিবার উদ্যোগটির জন্য অরুণ জেটলির যেমন ধন্যবাদ প্রাপ্য, তেমনই প্রশ্নটিকে তাহার যোগ্য গুরুত্ব দেওয়ার দাবিও একই সঙ্গে পেশ করিয়া রাখা প্রয়োজন।

Advertisement

আর্থিক সংস্কার বস্তুটি প্রধানমন্ত্রী কথিত ‘তিক্ত ঔষধ’ নহে, যাহা অনিচ্ছা সত্ত্বেও, প্রাণের দায়ে, গলাধঃকরণ করিতেই হয়। আর্থিক সংস্কার একটি পথ। বিশ্বাসজাত পথ। অর্থনীতির শিয়রে শমন উপস্থিত হইবার পরে নহে, এই পথে হাঁটিতে হয় পথটি কাম্য বলিয়াই। অলাভজনক কেন, কোনও সংস্থাকেই আর রাষ্ট্রায়ত্ত রাখিবার প্রয়োজন নাই। সার উত্‌পাদন, টায়ার নির্মাণ যেমন সরকারের কাজ নহে, তেমনই বিমান পরিবহণ অথবা কয়লা উত্তোলনও নহে। সরকারের কাজ ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ তৈয়ারি করিয়া দেওয়া, আইনের শাসন বজায় রাখা, বাজারে কোনও অন্যায় হইতেছে কি না, সে দিকে নজর রাখা। অর্থনীতির পরিসরে ‘ন্যূনতম সরকার’ বলিতে এইটুকুই বোঝায়। এবং, এই পথে হাঁটিবার ‘যথার্থ সময়’ এখনই। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি লাভে চলিতেছে কি না, সরকারের হাতে থাকিলে শ্রমিকদের লাভ না কি ক্ষতি, এই প্রশ্নগুলির উত্তর সন্ধানের প্রয়োজন নাই। বিপত্তারণ রূপে নহে, সংস্কারকে বরণ করিয়া লইতে হইবে সংস্কার জরুরি বলিয়াই।

দেওয়ালে পিঠ সম্পূর্ণ ঠেকিয়া না গেলে সংস্কারের কথা ভাবিবার অভ্যাস ভারতীয় রাজনীতিকদের নাই। ‘সংস্কারের ভগীরথ’ রূপে যিনি প্রাপ্যের অধিক প্রশংসা কুড়াইয়াছেন, সেই মনমোহন সিংহও নহেন, সাহসী অর্থমন্ত্রী পালনিয়াপ্পন চিদম্বরমও নহেন। সেই সনাতন রীতিটি ভাঙিবার সুবর্ণসুযোগ এখন। বিশ্ব-অর্থনীতি আপাতত সুস্থির। পশ্চিম এশিয়ায় কোনও অপ্রত্যাশিত সংকট আরম্ভ না হইলে তেলের দামও কমই থাকিবে। মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ-এর ডলার প্রবাহে রাশ টানিবার সিদ্ধান্তের ধাক্কা অনেকাংশেই সামলাইয়া দিয়াছে ব্যাঙ্ক অব জাপান। ভারতের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিও এক রকম ছন্দেই চলিতেছে। আর্থিক সংস্কারের পথে হাঁটিবার এই তো সময়। নরেন্দ্র মোদী আর্থিক সংস্কারকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন কি না, হয়তো অনেকের মনে তেমন সংশয় রহিয়াছে। প্রধানমন্ত্রীর ‘সুদৃঢ় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা’-র প্রতি আগ্রহ সেই সংশয়ের জন্ম দিয়াছে। এই সুযোগ। তিনি প্রমাণ করুন, তাঁহার নিকট ভারতের থ্যাচার হইয়া উঠিবার প্রত্যাশাটি ভিত্তিহীন নহে, সংস্কার জরুরি বলিয়াই তিনি সংস্কারের পথে হাঁটিবেন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement