ভারত, পাকিস্তান ও চিনের নৌবাহিনী পূর্ব চিন সাগরের সন্নিকটে যৌথ মহড়া দিতেছে-- আপাতদৃষ্টিতে সংবাদটি বিস্ময়কর মনে হইতে পারে। চিন এবং পাকিস্তান, উভয়ের সহিত অতীতে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ সংঘটিত হইয়াছে এবং বর্তমানেও প্রায়শ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে রণদামামা বাজিয়া ওঠে, হুমকি, হুঙ্কার শোনা যায়। সীমান্ত লইয়া, কে কাহার ভূখণ্ড দখল করিয়া আছে তাহা লইয়া এবং কে কাহার ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করিয়া ছাউনি বানাইতেছে, তাহা লইয়া কাজিয়ারও তো অন্ত নাই। সীমান্তে সেনা মোতায়েন, ট্যাংক ও সাঁজোয়া গাড়ি চলাচলের উপযোগী পাকা সড়ক এবং জঙ্গি বিমান ওঠা-নামার উপযোগী বিমানবন্দর নির্মাণের মধ্যেও প্রায়শ প্রকট বা প্রচ্ছন্ন থাকে পরস্পরের প্রতি রণং দেহি মনোভাব। সেই প্রেক্ষিতে একসঙ্গে চিন ও পাকিস্তানের রণতরী ও নৌবহর লইয়া দূর চিন সমুদ্রে ভারতীয় নৌবাহিনীর যৌথ মহড়া যেন ঠিক সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অথচ ঠিক তাহাই গত বুধবার ঘটিতে দেখা গেল। ভারতীয় ফ্রিগেট আইএনএস শিবালিক ছাড়াও আরও আঠারোটি রণতরী এবং সাতটি হেলিকপ্টার লইয়া ভারতীয় নৌবাহিনী মহড়ায় যোগ দিল।
মহড়াটির নাম দেওয়া হয়: নৌ-সহযোগিতা ২০১৪। পূর্বোক্ত তিনটি দেশ ছাড়াও তাহাতে যোগ দেয় বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই প্রভৃতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশও। নামেই স্পষ্ট, এই মহড়া ছিল বহুজাতিক সহযোগিতার। যুদ্ধ ছাড়াও নৌবাহিনীর আরও অনেক কাজ থাকে। দুর্ঘটনায় পড়া জাহাজের ফুরাইয়া যাওয়া রসদ সরবরাহ করা, বিপন্ন জাহাজ তল্লাশি করিয়া তাহার যাত্রী বা আরোহীদের রক্ষা করা, জলদস্যুদের হামলা ঠেকাইতে তত্পর হওয়া, জাহাজ ছিনতাই হইলে তাহা উদ্ধার করিয়া ছিনতাইকারীদের আটক করা, দীর্ঘ অঞ্চল জুড়িয়া নজরদারি চালানো এক কথায় সমুদ্রপথগুলি নিরাপদ করিয়া তোলা। পারস্য উপসাগর-সহ আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর এবং পূর্ব ও দক্ষিণ চিন সাগর জুড়িয়া বাণিজ্যের গুরুত্ব বিরাট। সমুদ্রবেষ্টিত দেশগুলি তাই পরস্পরের সহিত সহযোগিতা মারফত নিরাপত্তা নিশ্চিত করিতে চায়। ভারতের সহিত চিনের সম্পর্কে নিশ্চয় উত্তেজনার উপাদান আছে। এমনকী চিনা নৌশক্তিও উপকূলবর্তী ভিয়েতনামি তৈলসম্ভার অনুসন্ধানে আমন্ত্রিত ভারতীয় তৈল উত্খনন সংস্থার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করিতে চাহিয়াছে। চিন সাগরের সর্বত্র সমুদ্র-সম্পদের উপর চিনের নিরঙ্কুশ অধিকার ভারত মানে নাই বলিয়া কিছু জটিলতাও সৃষ্টি হইয়াছে। কিন্তু তাহাতে চিনের সহিত যৌথ নৌ-মহড়ায় বিঘ্ন ঘটে নাই।
বস্তুত, গত বছরও আইএনএস শিবালিক জাহাজটি সাংহাই বন্দরে শুভেচ্ছা সফরে গিয়াছিল। এ বারও চিনা বন্দরে নোঙর করিয়া থাকা শিবালিকে হাজার-হাজার চিনা দর্শক উত্সাহ ভরে দর্শনার্থী হইয়াছেন। চিনা নৌসেনারাও জাহাজটি পরিদর্শন করিয়া গিয়াছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য সমুদ্রবেষ্টিত রাষ্ট্রের সহিত ভারতের এই নৌ-সহযোগিতা কূটনীতির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্তের দুর্গমতম একখণ্ড জমির দখল লইয়া উত্তেজিত বাক্যবিনিময় ও হুমকিই ভারতের সহিত চিন ও পাকিস্তানের সম্পর্কের একমাত্র অভিজ্ঞান নয়। ওই রণং দেহি মনোভাব ও অবস্থানের মধ্যে নাটকীয়তা আছে, অতিরঞ্জনও আছে, যাহা নিজ-নিজ দেশবাসীর জাতীয়তাবাদী অহমিকাকে তুষ্ট করে। কিন্তু তাহার অন্তরালে পণ্য চলাচল চলিতে থাকে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আজ কোনও দেশের সঙ্গে ‘আড়ি’ করিয়া বিকশিত হইতে পারে না। রাজনৈতিক প্রচার, বিশেষত নির্বাচনকালীন দলীয় প্রচারে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ যত অপরাজেয়ই প্রতীয়মান হউক, শেষ বিচারে তাহাকে কূটনৈতিক বাস্তবতার উপর নির্ভর করিতেই হয়।