প্রবন্ধ ২

যে উদার সে উদো

ধর্মকে আঘাত করার অধিকার কারও নেই। ধর্মের কিন্তু, সব্বাইকে আঘাত করার অধিকার আছে। এই সিধে কথাটা বুঝে নিতে হবে। কেউ বলতে পারে, কার্টুন আঁকার চেয়ে খুন করাটা কি অনেক বেশি আঘাত নয়? আরে! মা’কে অপমান করলে কি তার উত্তরে আলতো চড় মারা যায়? বোনের গায়ে নোংরা হাত দিলে সে ভিলেনকে বুঝেশুনে লাথি কষানো যায়? না কি এমন বেধড়ক শিক্ষা দিতে হয় যাতে কোনও বাপের আওলাদের আর কখনও এমন চিন্তা মনের কর্নারেও আনার খ্যামতা না হয়?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:১০
Share:

ধর্মকে আঘাত করার অধিকার কারও নেই। ধর্মের কিন্তু, সব্বাইকে আঘাত করার অধিকার আছে। এই সিধে কথাটা বুঝে নিতে হবে। কেউ বলতে পারে, কার্টুন আঁকার চেয়ে খুন করাটা কি অনেক বেশি আঘাত নয়? আরে! মা’কে অপমান করলে কি তার উত্তরে আলতো চড় মারা যায়? বোনের গায়ে নোংরা হাত দিলে সে ভিলেনকে বুঝেশুনে লাথি কষানো যায়? না কি এমন বেধড়ক শিক্ষা দিতে হয় যাতে কোনও বাপের আওলাদের আর কখনও এমন চিন্তা মনের কর্নারেও আনার খ্যামতা না হয়? জানি, যাদের মেরেছি, তারা সমস্ত ধর্ম নিয়েই ফগড়ামি করত, নিজের ধর্মকেও ছেড়ে কথা বলত না। তাতে কী হল? কেউ যদি এমন চরিত্রহীন শুয়োর হয় যে নিজের বাপ-মা’কে কাপড় খুলে রাস্তায় বের করে দেয়, মুখে চুনকালি ছোড়ে, তা হলে কি তার অন্যের বাপ-মা’র সঙ্গে ওই কুচ্ছিত ব্যবহার করার অধিকার জন্মে যায়? ওরা পারভার্ট, নিজেদের পারভার্শন নিয়ে থাকুক, আমাদের বুকের ধন, চোখের মণির দিকে হাত বাড়ায় কোন সাহসে?

Advertisement

এই যে শুনি পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, বাক্স্বাধীনতার অধিকার, গাল ফুলিয়ে এমন উচ্চারণ করা হয় যেন খুব মহান মণ্ড। কিন্তু পাশ্চাত্যটা আসলে কী? পৃথিবীর পশ্চাদ্দেশ ছাড়া আর কিস্যুই নয়। যেখানে মেয়েরা আধন্যাংটো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মেয়ে মদ্দা সব্বাই জন্তুজানোয়ারের মতো রাস্তায় চুমোচুমি করছে, যে কোনও পরব এলে যে যার সঙ্গে খুশি গতর জাপ্টাজাপ্টি করে নাচছে, এমনকী বাপ-মেয়ে, শাশুড়ি-জামাই, ভাই-বোন, কিস্যু আগল নেই। আর নাটকে সিনেমায় সাহিত্যে টিভিতে কী হচ্ছে? হাততালি পাওয়ার জন্যে সব ভদ্রতা শালীনতা রুচিকে দলেমুচড়ে নিজেদের ভগবান নিয়ে রসিকতা করছে, ধর্মগুরু নিয়ে ব্যঙ্গ করছে, দেশের পতাকা পোড়াচ্ছে, সমাজের ছাল ছাড়াচ্ছে! এ তো বেলেল্লাপনার কারখানা! এটা স্মার্টনেস? সিভিলাইজেশন?

অনেক ধর্মেই দেখেছি, ভগবান নিয়ে হাসাহাসির চল! কোনও ধর্মে ভগবানের শুঁড় আছে, কারও চারটে হাত, কারও পাঁচটা মাথা। তাই নিয়ে সেই ধর্মেরই লোকেরা হেসে খুন হচ্ছে জোক বানাচ্ছে, দেবতাদের ফুটবল ম্যাচে দশহাতওলা দেবী গোলকি হয়ে সব গোল বাঁচিয়ে দিচ্ছে। কোনও ধর্মের অবতারের যৌন জীবন নিয়ে সিনেমা হচ্ছে! এই সব লোক আবার বুক বাজিয়ে বলে, তারা উদার। উদার নয় রে, উদো! মহান নয়, ক্যালাস! তোদের আত্মসম্মান নেই। নিজেরা নিজেদের মর্যাদা দিতে শিখিসনি। এর চেয়ে বড় পাপ আর কিচ্ছু হয় না। তোরা যাকে ভাবছিস সহনশীলতা, তা আসলে দুর্বলতা। রক্তে যাদের তেজ নেই, তাদের রোখ এমন দুব্লা।

Advertisement

প্রশ্ন হল, ধর্ম কী। ধর্ম কোনও গয়না নয়, যে, ইচ্ছে হলে পরলাম, ইচ্ছে না হলে পরলাম না। ধর্ম হচ্ছে গার্জেন। মানুষকে ঠিক পথে রাখার চৌকিদার। মানুষকে একলাখ নিষেধ দিয়ে বেঁধে, শেকল দিয়ে সিধে রেখে, চাবকে এবং ধমকে, ন্যায়ের ধরতাই দিয়ে যাওয়ার পাহারোলা। ধর্ম বলে দেবে, কে পা টিপবে, আর কে পা টেপাবে। কাদের জন্যে মেয়ে ধরে নিয়ে আসা হবে ক্রীতদাসী করতে, আর কারা সেই মেয়ে জোগাবে। কারা থাবড়া মেরে সাধারণ মানুষের ঘর খাবার বিছানা কাড়বে, আর কেন সাধারণ লোক সে সব খুইয়ে মুখ বুজে সেলাম ঠুকবে। ধর্মের যুদ্ধ করতে যে যাচ্ছে, বীরশ্রেষ্ঠ। সে যখন মিটিং রুমে ঢুকে নিরস্ত্র লোকের ওপর গুলি চালাচ্ছে, দুর্দান্ত সাহসের কাজ করছে, ইতর পৃথিবীতে ন্যায় আনছে।

ফট করে এগুলো মাথায় ঢুকবে না, মনে হবে, নিরীহ লোককে মারল। কে নিরীহ? যে আমাদের সবচেয়ে পবিত্র বেদীকে পায়ের ছাপে নোংরা করছিল? বা, যে তা দেখে হাততালি দিচ্ছিল? বা, যে এ সব কিছুই করছিল না, কিন্তু এই ব্যবস্থার দিব্যি বল্টু হয়ে ঘুরছিল? ধর্ম বলে, এদের টুকরো টুকরো করে রক্তগঙ্গা বইয়ে দাও। গণখুন করো।

না, ধর্ম ক্ষমা-টমার কথা বলে না। ওগুলো ভীরুদের ব্যাখ্যা। ঈশ্বর অভিশাপ দিতে খুব ভালবাসেন। তা ছাড়া, জগৎ জুড়ে আমাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত চলছে, আমাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি পাশ্চাত্যের গোটা পাশাটাকে হুড়মুড়িয়ে উলটে দিতে পারে, এই ভয়ে ওরা ক্যাম্পেন, মিছিল, গালি মচাচ্ছে, আর আমরা গলায় ক্ষমার লকেট ঝুলিয়ে বসে থাকব? কেউ বলছে, তোমরাও কার্টুন আঁকছ না কেন? খরখরে লেখা লিখছ না কেন? আরে, ও সব নেকুপুষু কাঠি-করায় আমরা নেই রে! আমরা বুক চিতিয়ে লড়ব, সিনেমা হল-এ বোম রাখব, স্টেশনে, বাজারে, হোটেলে, পার্কে সবার হাত-পা উড়িয়ে দেব, কাগজের অফিস পুড়িয়ে দেব, প্রতিবাদীকে পুঁতে দেব। আজ অবধি কেউ কাউকে লিখে শুধরোতে পেরেছে? কিন্তু আড়ং ধোলাই দিলে? বিশ্বের সব দুষ্টুমি শুধরে গেছে।

যুগে যুগে ধর্ম শিখিয়েছে, অন্য ধর্মকে মার। পেটা। অবিশ্বাসীর মুন্ডু ছিঁড়ে দে। এটাই ধর্মের স্বর্ণশিক্ষা। ক্রুসেড থেকে আজ অবধি এই সদুপদেশই বয়ে আসছে। সব ধর্মেই কিছু ভাল লোক থাকে, যারা এই শিক্ষাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে। কিছু সাধারণ লোকও থাকে, যারা হাবলার মতো জিজ্ঞেস করে, আমার ধর্মের ইজারা তোমায় কে দিল। তাদেরও তখন বন্দুকটা বের করে দেখাতে হয়। বন্দুক হল ধর্মের সবচেয়ে বন্ধু। ফুলপাতার চেয়ে অনেক জরুরি উপচার। ধর্মকে সত্যিকারের ভালবাসা মানে, বন্দুক ছুরি আধলা ইট নিয়ে বিরোধীদের তেড়ে মারতে যাওয়া। যাতে, কোনও হতভাগার মনে এতটুকু সন্দেহ না থাকে, কোন ধর্ম শ্রেষ্ঠ। এই তো, এখন ঢঙের মোমবাতি-প্রতিবাদ হবে। লেকচারও চলবে। কিন্তু মনের আসলি শেকড়ে? ভয় থরথরাবে। কার্টুন আঁকার আগে আন্টার্কটিকার শিল্পীও বিশ লাখ বার ভাববে। বাসেট্রামে মুখ খোলার আগে, মেচেদার মস্তানও কুঁকড়ে গিয়ে আশপাশটা দেখে নেবে। গুলিটা আসলে তোমাদেরই করেছি।

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement