আজব রাজ্য বটে। এখানে শিশুরা পণ্য হইয়াছে, আর প্রশাসন শিশু হইয়াছে। সরকারি কর্তাদের যে প্রশ্নই করা হউক, শিশুসুলভ সারল্যে তাঁহারা বলেন, ‘জানি না তো!’ মন্ত্রী জানেন না তাঁহার অধীনস্থ হোম হইতে শিশু পাচার হইতেছে, জেলা প্রশাসন কিংবা স্বাস্থ্য দফতর জানে না নার্সিং হোমগুলিতে কত শিশু জন্মাইতেছে বা মরিতেছে। সমাজ কল্যাণ দফতর জানে না কত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হোম চালাইতেছে, সেগুলিতে কত শিশু থাকিবার কথা, কত রহিয়াছে। কেন্দ্রীয় শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিটির প্রাথমিক তদন্তেই স্পষ্ট যে, শিশু সুরক্ষার পরিকাঠামোটি নির্মাণ করিতে যে ন্যূনতম তথ্য প্রয়োজন, তাহার কিছুই প্রশাসন বা পুলিশের নিকট নাই। পশ্চিমবঙ্গ শিশু পাচারের মুক্তাঞ্চল। অথচ রাজ্যেও একটি শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিটি রহিয়াছে। তাহার কাজ সরকারের উপর নজরদারি। সেই কমিটির চূড়া বদলাইয়াছে, সরকার-অনুগত চরিত্রটি বদলায় নাই। তাই কেন্দ্রীয় কমিটিকে মনে করাইতে হইল, শিশুর নিরাপত্তার প্রাথমিক শর্তগুলিও অপূর্ণ। স্বাস্থ্য, নারী ও শিশু দফতর, সমাজ কল্যাণ, স্বরাষ্ট্র— সব দফতরই শিশুসুরক্ষার তথ্য সংগ্রহ করিতে ভুলিয়াছে। জেলা প্রশাসনও তথৈবচ। ফলে জেলায় জেলায় বিনা অনুমোদনে বহু নার্সিং হোম চলিতেছে। তাহাদের নথিপত্রে বিস্তর গরমিল। হোমগুলিতে শিশুর সংখ্যা, দত্তকের তথ্যে গরমিল। সরকারি হেফাজতেও শিশুরা উধাও হইয়া যাইতেছে।
এই ‘ডিজিটাল’ যুগেও একটি নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কে শিশুসুরক্ষা সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণের কথা কাহারও মনে হয় নাই, ইহার অধিক বিস্ময়ের আর কী হইতে পারে। সরকারি প্রকল্পে বিতরণযোগ্য সাইকেল বা ত্রিপল যে সম্মানটুকু পায়, সরকারি সুরক্ষাব্যবস্থায় সদ্যোজাত মানবশিশু তাহাও পায় নাই। শিশুপাচার, বিক্রয়, খুনের যে চিত্র সম্প্রতি প্রকাশিত হইয়াছে তাহাতে রাজ্যবাসী স্তম্ভিত বলিলে কম বলা হয়। কিন্তু কত অপরাধ আড়ালে রহিয়া গেল, কত অপরাধী না-ধরা রহিল, কত শিশু নিরুদ্দেশ, মৃত, কে বলিতে পারে? এবং ইহার পরে এমন অপরাধ যে আর ঘটিবে না, তাহারও কিছুমাত্র নিশ্চয়তা নাই। শিশুর অধিকারের এমন অবমাননা যুদ্ধরত দেশগুলিতেও ঘটে কি?
এই রাজ্যে শিশুরা বিপন্ন, তাহার প্রমাণ বারংবার মিলিয়াছে। নাবালিকা পাচারে পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষে। বালিকাবিবাহ, অ কালপ্রসব, স্কুলছুটের হার ও শিশুশ্রম, প্রতিটির হার অতি উচ্চ। বিপজ্জনক কাজে শিশুদের নিয়োগ করিবার দালালরা সদাসক্রিয়, পিংলার বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে নিহত শিশুরা তাহার নজির। দুঃস্থ ছাত্রীদের যৌননির্যাতনের ঘটনা বিস্তর। সদ্যোজাত শিশুরাও যে বিপন্ন হইবে, ইহা প্রত্যাশিতই ছিল। বিশেষত দত্তক-সংক্রান্ত আইন কঠোর হইবার পর শিশুর চাহিদা বাড়িয়াছে। শিশু পাচার, বিক্রয় করিতে গিয়া অনেকে ধরা পড়িয়াছে। কর্তারা উদাসীন। অথচ শিশুর সুরক্ষার জন্য গ্রাম পঞ্চায়েত ও পুরসভার ওয়ার্ড স্তরে কমিটি হইয়াছে। প্রতিটি জেলায় শিশু কল্যাণ সমিতি আছে। চালু আছে নিবিড় শিশু সুরক্ষা প্রকল্প। তাহাদের পরিদর্শনের জন্য আছে রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিটি। ইহাদের তবে প্রয়োজন কী? সামগ্রিক ভাবেই এক ছবি। মহিলা কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, তথ্যের অধিকার কমিশন, কোনওটিই রাজ্য সরকারকে সতর্ক করিতে বা প্রকাশ্যে সরকারি গাফিলতির সমালোচনা করিতে সাহস পায় না। নিজের পদটি সুরক্ষিত রাখাই সদস্যদের প্রধান কাজ। শিশু, মহিলা, নাগরিক মরিলে কী আসিয়া যায়?