জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ে আমেরিকার তেল শিল্প একটা বড় বাধা। আমেরিকার সচেতন মানুষ চেষ্টা করছেন এই বাধা অতিক্রম করে আমেরিকাকে এই যুদ্ধে শামিল করতে। কিছুটা সাফল্য তাঁরা পেয়েছেন। তাঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ব্যারাক ওবামা। প্রেসিডেন্ট ওবামার কিন্তু সময় বেশি নেই। আসন্ন নির্বাচনে জিতলে ডেমোক্র্যাট পার্টি এই কাজ চালিয়ে যাবে বলেই মনে হয়। কিন্তু রিপাবলিকান পার্টি ক্ষমতায় এলে নতুন উদ্যোগ তো নেওয়া হবেই না, প্রেসিডেন্ট ওবামা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা-ও রাখা হবে কি না সন্দেহ আছে।
অন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশ, চিনের কী খবর? চিনের কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত সরকার নিঃসরণ কমাবার জন্য একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। এই পার্টিকে নির্বাচনে দাঁড়াতে হবে না, কাজেই হঠাৎ নীতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। চিনের তেল শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত।
এই শিল্প সরকারি নীতিকে প্রভাবিত করতে পারে না। চিনের অর্থনীতি যদিও দ্রুত বেড়েছে, আমেরিকার তুলনায় চিন এখনও গরিব দেশ। আমেরিকার মাথাপিছু বার্ষিক আয় চিনের নয় গুণ। চিন বিলাসী দেশ নয়। চিনের নাগরিক ১০০ টাকা রোজগার করলে ৫০ টাকা সঞ্চয় করেন। আমেরিকার মানুষ সঞ্চয় করেন ১৫ টাকা। আমেরিকায় ১০০০ নাগরিক পিছু গাড়ির সংখ্যা ৮০০, চিনে ১১০। সরকার রাশ টেনে ধরলে নাগরিকের দিক থেকে খুব বিরোধিতা হবে না। তাই মনে হয় ভবিষ্যতেও চিনের সরকার উষ্ণায়ন রোধে কড়া অবস্থান নিতে পারবে।
গত কুড়ি বছরে চিনে অর্থনীতির দ্রুত বৃদ্ধির সঙ্গে নগরায়ণও হয়েছে দ্রুত। আজ চিনের অর্ধেকের বেশি মানুষ শহরে বাস করে। গোড়ার দিকে সরকার পরিবেশ দূষণের উপর নজর রাখেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি অনুযায়ী প্রাদেশিক সরকার শিল্পায়নের কাজ পরিচালনা করেছে স্বতন্ত্র ভাবে। ফলে কারখানাগুলি হয়েছে ছোট আর জ্বালানির ব্যবহারে দক্ষতা হয়েছে কম। ইস্পাত বা সিমেন্ট তৈরি করতে যত জ্বালানি লাগার কথা, লেগেছে তার অনেক বেশি। কয়লার ব্যবহার হয়েছে যথেচ্ছ। চিন এখন বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টন কয়লা পোড়ায়। বায়ু দূষণের হিসেবে বেজিং এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূষিত শহর। বিশ্বের যে ২০টি শহরে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি, তাদের মধ্যে ১৬টি চিনের। বায়ুদূষণের ফলে চিনে বছরে ১২ লক্ষ মানুষের অকালমৃত্যু হয়। দিল্লিতে এখন জোড়-বেজোড় সংখ্যা দেখে গাড়ি চালানো হচ্ছে, মাঝেমধ্যে গাড়ি-মুক্ত দিবস পালন করা হচ্ছে। চিনে এগুলি চালু হয়েছে অনেক দিন আগে।
২০০৮ সালের ‘অলিম্পিক গেমস’-এর আগেই সরকার বাধ্য হয় এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে। পরিবেশ দফতরকে পূর্ণ মন্ত্রকে পরিণত করা হয়। ২০১৪ সালে নতুন পরিবেশ রক্ষা আইন পাশ হয়। আজ যে চিন সরকার উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়েছে, তার একটা বড় কারণ এই বায়ুদূষণ। চিনে প্রতিবাদ, মিছিল ইত্যাদি কমই হয় কিন্তু বায়ুদূষণের প্রশ্নে কয়েক হাজার মিছিল হয়েছে। মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। চিনের শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ মনে করেন বিশ্ব উষ্ণায়ন একটি বড় সমস্যা। প্রয়োজন হলে সোশ্যাল মিডিয়া উষ্ণায়নের বিরুদ্ধেও সরব হতে পারে।
চিন সরকারের উদ্যোগের পিছনে আরও কারণ আছে। ১৯৬০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ার পরে জাতীয় নিরাপত্তা চিনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। শুধু সামরিক নিরাপত্তা নয়, শক্তি-নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমদানি করা জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমাতে জলবিদ্যুৎ, পরমাণু শক্তি এবং পরে সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানো হয়। এই পদক্ষেপগুলির ফলে শক্তি-নিরাপত্তা যেমন বেড়েছে, গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ তেমনই অনুপাতে কমেছে। ২০১৪ সালে চিন ৯০০০ কোটি ডলার খরচ করে সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা বাড়াতে। এটা ছিল আমেরিকার চেয়ে ৭৩% বেশি!
এর ফলে এই সালে প্রথম বার চিনে কয়লার ব্যবহার কমেছে। চিন ঘোষণা করতে পেরেছে যে তাদের জিএচজি নিঃসরণ ২০৩০-এর পরে কমতে শুরু করবে। চিন এ-ও ঘোষণা করেছে যে ২০২২ সালের মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হবে ১ লক্ষ মেগাওয়াট আর বায়ুবিদ্যুৎ— ২ লক্ষ মেগাওয়াট। ২০৩০ সালে দেশের মোট শক্তির ২০% আসবে পরিচ্ছন্ন, নিঃসরণ-মুক্ত উৎস থেকে।
এই ঘোষণাগুলি যে সবাইকে উৎসাহিত করেছে তাতে সন্দেহ নেই। তবে এই কর্মসূচি সফল হওয়ার একটা শর্ত আছে। চিনের আর্থিক অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে বিপুল পরিমাণ রফতানির ফলে। চিন যত কম দামে তাদের পণ্য বিশ্বের বাজারে পৌঁছে দিয়েছে আর কেউ তা পারেনি। চিন কখনওই চাইবে না অন্যান্য দেশের তুলনায় তাদের উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাক। তাই চিন একক ভাবে বেশি দিন কিছু করবে না। চিন যদি দেখে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলি তাদের অবস্থান বদলাচ্ছে, তা হলে খুব সম্ভব সে-ও পিছিয়ে যাবে।
উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ করা হলে সারা পৃথিবীতেই বিদ্যুৎ আর পেট্রলের দাম বাড়বে। দাম বাড়বে কৃষিজাত ও শিল্পজাত সব সামগ্রীর। আর তেমন পদক্ষেপ যদি না করা হয় তা হলে বাড়বে বন্যা, খরা, প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝা ও বাড়তি অসুখবিসুখের প্রকোপ আর সমুদ্রতটের প্লাবন। ব্যবস্থা নেওয়া হলে ক্ষয়ক্ষতি কম হবে। বাড়তি খরচটা উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়া যাবে। ব্যবস্থা না নেওয়া হলে কোনও দেশ কম ভুগবে, কোনও দেশ বেশি। মোটামুটি ভাবে গরিব দেশগুলিই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমেরিকা হয়তো পারবে বহু বছর নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে-ও রক্ষা পাবে না।
প্যারিসে যে সমঝোতা হয়েছে সেটাকে পাঁচ বছর অন্তর ঘষেমেজে উপযুক্ত করে তুলতে হবে। আমেরিকা ও চিন আমাদের সঙ্গে থাকলে এই কাজ সহজ না হলেও অসম্ভব হবে না। কিন্তু আমেরিকা মুখ ফিরিয়ে নিলে কি প্যারিসের বোঝাপড়াও ‘কিয়োটো প্রোটোকল’-এর মতো কাগজেকলমে রয়ে যাবে? চিন কি পারবে নেতৃত্ব দিতে? চিনের নেতৃত্ব কি রাশিয়া, জাপান বা ভারতের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে? চিনকে চেষ্টা করতে হবে প্রতিবেশীদের আস্থা অর্জন করতে। চিনের অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেয়েছে। চিন যদি অর্থনীতিকে আবার চাঙ্গা করতে পারে, তা হলে একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে। তত দিনে অবশ্য অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যাবে। ভূতপূর্ব মুখ্য সচিব, পশ্চিমবঙ্গ সরকার।