ক্লাইভ-এর যে ব্যাপারটি আমার ভাল লাগে তাহা হইল, তিনি আজ আর জীবিত নাই।— রবার্ট ক্লাইভ সম্পর্কে সুরসিক ব্রিটিশ লেখক এডমন্ড ক্লেরিহিউ বেন্টলি-র এই মন্তব্যটি মনে পড়াইয়া দিলেন কেন্দ্রীয় দূরসংযোগ মন্ত্রী রবিশংকর প্রসাদ। তাঁহার দফতর একটি ‘বিশেষজ্ঞ’ গোষ্ঠীকে জাতীয় এনক্রিপশন নীতির খসড়া তৈয়ারির দায়িত্ব দিয়াছিল। বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের বার্তা পাঠাইবার জন্য ‘এনক্রিপশন’ বা সংকেত-আবরণী ব্যবহার করা হয়, যাহাতে সেই বিশেষ সংকেত কাজে লাগাইয়া আবরণ উন্মোচন না করিলে বার্তাটি জানা না যায়। সরকারি গোষ্ঠীটি কয়েকটি বিধি আরোপের প্রস্তাব করিয়াছিল। তাহাদের মধ্যে দুইটি গুরুতর। এক, কোন সংকেত-কাঠামো ব্যবহার করা হইবে, তাহার জন্য আগে হইতে সরকারি অনুমোদন লওয়া আবশ্যক। দুই, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে প্রাপ্ত শব্দ, ছবি ইত্যাদি বার্তা নব্বই দিন অবধি মুছিয়া দেওয়া চলিবে না এবং ওই সময়ের মধ্যে সরকার চাহিলে তাহা দেখাইতে হইবে। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সমস্বর প্রতিবাদ উঠিয়াছে। মন্ত্রিবর পত্রপাঠ ‘উহা প্রস্তাবমাত্র, সরকারি নীতি নহে’ বলিয়া খসড়াটি প্রত্যাহার করিয়া লইয়াছেন। প্রস্তাবটি মৃত, ইহাই তাহার ভাল দিক।
কিন্তু বিড়াল চলিয়া গেলেও হাসিটি থাকিয়া গিয়াছে। সেই হাসি উদ্বেগজনক। যে মানসিকতার তাড়নায় ব্যক্তিগত বার্তার উপর সরকারি নজরদারির কথা ভাবা হইতে পারে, তাহা কেবল উদ্বেগ নহে, আতঙ্কের কারণ। নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বে এই আতঙ্ক ঘনায়মান, কারণ নানা দিক হইতে সরকারি খবরদারির বাসনা বা উদ্যোগ প্রকট হইতেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর সরকারি কর্তৃত্ব বাড়াইবার চেষ্টা পূর্ব জমানাতেও ছিল, কিন্তু ‘ন্যূনতম সরকার’-এর প্রতিশ্রুতি দিয়া ক্ষমতায় আসা মোদী সরকারের আমলে সেই চেষ্টা আরও প্রবল, আরও উত্কট। আয়কর দাখিলের ফর্মে করদাতার বিদেশ ভ্রমণের বিবরণ দাবি করিবার উদ্যোগ অরুণ জেটলির দফতরকে প্রবল প্রতিবাদের মুখে পড়িয়া প্রত্যাহার করিতে হইয়াছে। বৈদ্যুতিন বার্তার উপর নিয়ন্ত্রণ জারির নূতন প্রয়াসটি এই প্রেক্ষিতে দেখিলে সংশয় হয়, ‘প্রস্তাবমাত্র’ নহে, ইহার পিছনে কর্তৃত্বের মানসিকতা জোরদার। এই মানসিকতা মজ্জায় মজ্জায় গণতান্ত্রিক উদারতার প্রতিকূল।
‘নিরাপত্তা’র যে যুক্তিটি নজরদারির কারণ হিসাবে দেখানোর চেষ্টা চলিয়াছে, তাহা হাস্যকর অজুহাত। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের সহিত নিরাপত্তার সম্পর্ক অবশ্যই আছে, কিন্তু তাহা অনেক সূক্ষ্ম এবং জটিল, নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট প্রয়োজনে নজরদারি চালাইতে হয়, আল-কায়দার মতো বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর ক্রিয়াকলাপ, বিশেষত আর্থিক লেনদেনের সূত্র উদ্ঘাটনে তেমন নজরদারি বড় ভূমিকা লইয়াছে। কিন্তু তাহার জন্য সমস্ত নাগরিকের সমস্ত মেসেজ তিন মাস জমাইয়া রাখিতে বলা হয় নাই। বস্তুত, সংকেতমুক্ত বার্তাগুলি এত দিন ধরিয়া জমাইয়া রাখিলেই বরং নিরাপত্তাহানির আশঙ্কা বাড়ে। আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত বার্তা সংকেতের মোড়কে পুরিয়া দেওয়া হয় নিরাপত্তার জন্যই। নজরদারির প্রস্তাবটি তাই নির্বোধও বটে। নির্বোধ এই কারণেও যে, তিন মাস ধরিয়া স্থিরচিত্র ও ভিডিয়ো সহ সমস্ত বার্তা জমাইয়া রাখা মোবাইল টেলিফোনের সঞ্চয়-সামর্থ্যে কুলাইবে না। যাঁহারা এই নিয়ম চালু করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে তাঁহাদের ধারণাও নিতান্ত অপরিণত। অহেতুক খবরদারির স্বভাব বিপজ্জনক। তাহার সহিত অজ্ঞতা মিলিলে বিষম বিপদ।