জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ‘প্যারিস সমঝোতা’য় বলা হয়েছে যে ক্ষুদ্র দ্বীপে অবস্থিত রাষ্ট্রগুলিকে বাঁচাবার জন্য চেষ্টা করা হবে বিশ্ব উষ্ণায়ন ১.৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখতে। যখন দু-ডিগ্রির লক্ষ্যমাত্রাই পূরণ করা যাচ্ছে না, তখন ১.৫ ডিগ্রির কথা বলা হচ্ছে কোন যুক্তিতে? এই অলীক স্বপ্নের পিছনে না ছুটে বরঞ্চ ধরে নেওয়া যায় যে এই লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে না। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে দ্বীপগুলি জলমগ্ন হবে এবং ৫-৬ কোটি মানুষ গৃহহারা, দেশহারা হবে। শরণার্থীরা ভিড় জমাবেন অস্ট্রেলিয়ায়, ইউরোপে, আমেরিকায়। এই দেশগুলি চাইবে যে ভারত, িচনের মতো দেশও কিছুটা ভার বহন করুক। প্রশ্নটির মীমাংসার জন্য প্রয়োজন হবে আরও একটি আন্তর্জাতিক বৈঠকের। সেই বৈঠকের আয়োজন এখনই শুরু করলে হয়তো সময় মতো একটা সিদ্ধান্তে আসা যায়।
প্রতি বছরই আমরা দেখি প্রায় দুশোটি দেশ রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে মিলিত হয় জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করতে, কখনও প্যারিসে, কখনও কানকুন-এ, কখনও কোপেনহেগেন-এ। সন্দেহ নেই, এই বর্ণাঢ্য সম্মেলনগুলি আমাদের আশা জিইয়ে রাখে। না হলে আমরা জলে ডোবার আগেই হতাশায় ডুবে যেতাম। কিন্তু এই সভা কি পারবে সমস্যার মূলে আঘাত করতে?
সমস্যার সৃষ্টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আমেরিকা চাইলে এই সমস্যার সমাধান হবেই। আমেরিকা না চাইলে কোনও আন্তর্জাতিক সভাই পারবে না সমস্যার সমাধান করতে। ১৯৯৭ সালের কিয়োটো সমঝোতা সফল হয়নি আমেরিকার বিরোধিতায়। তখন তাদের বক্তব্য ছিল যে চিন আর ভারতকেও নিঃসরণ কমাবার দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু চিন ও ভারত নিঃসরণ কমালে তারা নিজেরা কী করবে সে সম্বন্ধে কোনও ইতিবাচক কথা তারা বলেনি।
বিশ্বে এখন গ্রিনহাউস গ্যাসের (জিএচজি) নিঃসরণের পরিমাণ বছরে ৪৯০০ কোটি টন কার্বন-ডাইঅক্সাইড-এর সমান। বিশ্ব উষ্ণায়ন যদি দু’ডিগ্রিতে সীমিত রাখতে হয়, তা হলে ২০৫০ সালের মধ্যে এই পরিমাণ ৮০ শতাংশ কমাতে হবে এবং ২১০০ সালের আগেই শূন্যে নিয়ে যেতে হবে। প্যারিস-এর সভায় বিভিন্ন দেশ যে অঙ্গীকার করেছে তাতে উষ্ণায়ন পৌঁছবে তিন ডিগ্রিতে। তাই ঠিক হয়েছে পাঁচ বছর অন্তর বসে চেষ্টা করা হবে নিঃসরণ আরও কমাবার। কাজটা যে সহজ হবে না তা সবাই স্বীকার করেন।
সবচেয়ে বেশি নিঃসরণ এখন হচ্ছে চিন থেকে। বছরে ১০৫০ কোটি টন। এর পর আছে আমেরিকা— ৬৫০ কোটি টন। তা হলে চিনকে বাদ দিয়ে আমেরিকার কথা বলছি কেন? চিন এক নম্বরে এসেছে অতি সম্প্রতি। এত দিন আমেরিকার নিঃসরণ ছিল সবচেয়ে বেশি। ১৮৫০ থেকে যত জিএচজি নিঃসরণ হয়েছে, তার ১৪ শতাংশ হয়েছে আমেরিকা থেকে, মাত্র ৪ শতাংশ চিন থেকে। চিনের মাথাপিছু নিঃসরণ আমেরিকার তুলনায় অনেক কম।
চিনের নিঃসরণ বেশি, কারণ পুরনো প্রযুক্তি। আমেরিকার বেশি, কারণ অতি বিলাসিতা। চিন প্রযুক্তি উন্নত করতে ঠিক পারবে। আমেরিকা পারবে তো লাইফসটাইল বদলাতে? এ-ও মনে রাখতে হবে যে আমেরিকা বছরে চল্লিশ হাজার কোটি ডলারের সামগ্রী আমদানি করে চিন থেকে। এই সামগ্রীর উৎপাদনে যে নিঃসরণ হয় তার জন্য আমেরিকাই দায়ী।
বিশ্ব উষ্ণায়ন সম্বন্ধে দেশের নাগরিক কতটা সচেতন, তাই নিয়ে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই সমীক্ষা হয়েছে। উন্নত দেশগুলির মধ্যে আমেরিকার মানুষ সবচেয়ে কম সচেতন। কিছু দিন আগেও আমেরিকার শতকরা মাত্র ৩৩ জন এই সমস্যাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। ইদানীং এই অনুপাত বেড়ে শতকরা ৪৪ হয়েছে। তুলনায় ইউরোপে শতকরা ৬৮ জন মনে করেন এটি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা।
আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টি উষ্ণায়নের প্রতিরোধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোর বিরোধী। শিল্পে বাণিজ্যে সরকারি হস্তক্ষেপ এক বার শুরু হলে তার পরিণতি হবে কমিউনিজম! তারা মনে করে পুরো ব্যাপারটাই বামপন্থীদের মনগড়া। আমেরিকার সর্বশক্তিমান তেল শিল্প বোঝে যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলে তাদের ঝাঁপ বন্ধ হবে। এই শিল্প তাই কোটি কোটি ডলার খরচ করে এর বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে।
রাষ্ট্রপুঞ্জের তৈরি সংস্থা আইপিসিসি বিশ্ব জুড়ে ছয় হাজারেরও বেশি বিজ্ঞানীকে একত্র করেছে বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে গবেষণার জন্য। তাদের মতে এটি একটি ভয়াবহ সমস্যা এবং এখনই দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আমাদের হাতের বাইরে চলে যাবে। আমেরিকায় কিন্তু অনেক বিজ্ঞানী এখনও প্রকাশ্যে বলেন যে, বিশ্ব উষ্ণায়নে মানুষের হাত নেই! আর আমেরিকার বেশির ভাগ ‘থিংক ট্যাংক’ চলে তেল শিল্পের অনুদানে। এদের কাজ হ’ল সরকারি নীতি প্রভাবিত করা। আমেরিকার মিডিয়া এখনও উষ্ণায়ন নিয়ে চিন্তিত নয়। মানুষও ভুলে থাকতে রাজি— যারা সিগারেট খায় তাদের সবার তো ক্যান্সার হয় না। আর লাইফস্টাইল পরিবর্তনের কষ্ট সিগারেট ছাড়ার কষ্টের চেয়ে ঢের বেশি।
এই অবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে আমেরিকার মানুষকেই। আমাদের কী করণীয়? সে কথা বোঝাতে পরিবেশবিদ জর্জ মনবিয়ো একটি সুন্দর উপমা দিয়েছেন। নিউ ইয়র্কের মাঝখানটা উঁচু। যারা সাইকেল চালায়, তারা উঁচু জায়গাটিতে এসে অপেক্ষা করে। যেই দেখে সব বাতি সবুজ, তখন চট করে স্টার্ট নিয়ে কোথাও না থেমে বেরিয়ে যায়। আমেরিকাও স্টার্ট করার আগে একাধিক সবুজ বাতি দেখতে চায়। চিন ইদানীং প্রযুক্তি উন্নয়নের দিকে নজর দিয়েছে। তাদের নিঃসরণ ২০৩০ সালে সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে তার পর নামতে শুরু করবে, এই ঘোষণাও তারা করেছে। আমেরিকায় কিছুটা হলেও যে ভিন্নমত তৈরি হচ্ছে, মনবিয়ো মনে করেন তা চিনের এই পরিবর্তনের জন্য।
ভারতও বলেছে ২০২২ সালের মধ্যে ১৭৫ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি হবে পুনর্নবীকরণীয় শক্তি থেকে। এটা কম কথা নয়। কয়লার ব্যবহার কত দ্রুত কমবে সে সম্বন্ধে আমরা এখনও কিছু বলতে পারিনি। তবে পাঁচ বছরের মধ্যে সেটা ঠিক করতেই হবে, না হলে সমালোচনা হবে। যা-ই করি না কেন, খেয়াল রাখতে হবে তার পরিবর্তে আমেরিকা কতটা করতে রাজি হল। রাষ্ট্রপুঞ্জের সভায় বসলে মনে হবে সব দেশই সমান, নিজ নিজ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত। আমেরিকাই কিন্তু আসল খেলোয়াড়।
সেই আমেরিকাতেও পরিবর্তন হচ্ছে। হারিকেন, ক্যাটরিনার মতো বিধ্বংসী ঝড়ের পরে হারিকেন স্যান্ডি, তার পর মিনেসোটার ঝড়ের ঝাপটায় অবিশ্বাসের ভিত নড়েছে। অ্যাল গোর এবং নেওমি ক্লাইনের কথা বহু মানুষ শুনছেন। কমিউনিটি, ইউনিভার্সিটি, মিউনিসিপ্যালিটি স্তরে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে আমেরিকার মূল মন্ত্র এখনও ভোগবাদ, তাকে কোনও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি।
ভূতপূর্ব মুখ্য সচিব, পশ্চিমবঙ্গ সরকার