জ নগণনা, তুমি কোথা হইতে আসিতেছ? উত্তর সহজ: রাষ্ট্র হইতে। রাষ্ট্রচালনা উন্নত হইতে উন্নততর করিবার লক্ষ্যে নাগরিকদের মাথা গনিবার বুদ্ধি আক্ষরিক অর্থেই আন্তর্জাতিক। মিশর হইতে গ্রিস, চিন হইতে রোম, দুনিয়ার নানা প্রান্তে কয়েক হাজার বছর আগেই শাসকরা অধিবাসীদের সংখ্যার হিসাব কষিয়াছেন। ইহা তাৎপর্যপূর্ণ যে, ভারতে জনগণনার প্রথম সুগঠিত উদ্যোগ হইয়াছিল চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজত্বে, অর্থশাস্ত্রকার কৌটিল্যের নির্দেশনায়। অনেক ক্ষেত্রেই গণনার পরিধি ছিল নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সীমিত। ‘সেনসাস’ শব্দটির জন্মভূমি রোম সাম্রাজ্যেও কেবল অস্ত্রধারণক্ষম পুরুষদেরই গণনা করা হইত। একটি রাষ্ট্রসীমার মধ্যে বসবাসকারী সমস্ত নাগরিকের সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করিবার অর্থে এই শব্দের ব্যবহার নিতান্ত আধুনিক। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূত্রে ভারত এই সামগ্রিক জনশুমারির উত্তরাধিকার অর্জন করে এবং অন্য অনেক রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকারের মতোই যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে তাহার নিয়মিত অনুশীলন করিয়া চলে। তাহার পরিণামে ভারতীয় জনশুমারির দশসালা রিপোর্টগুলি পরিসংখ্যানের এক অতুলনীয় আকরে পরিণত হইয়াছে, সেনসাস রিপোর্ট ব্যবহার করিয়া এক দিকে বিপুল গবেষণা হইয়াছে ও হইতেছে, অন্য দিকে নীতি রচনার কাজে এই নথিগুলি অমূল্য। জনশুমারির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
গুরুত্ব দুই দিকেই কাটে। জনশুমারিকে কী ভাবে ব্যবহার করা হইতেছে, তাহার উপর এই তথ্যপঞ্জির প্রভাব প্রতিক্রিয়া বিশেষ ভাবে নির্ভর করে। সদ্ব্যবহার ও অপব্যবহার, দুইই সম্ভব। ভারতীয় রাজনীতিতে অপব্যবহার বা তাহার আশঙ্কা নূতন নহে। এই আশঙ্কাতেই ১৯৩১ সালের পর হইতে ২০০১ অবধি জনশুমারিতে ‘কাস্ট’ অর্থাৎ জাতপাতের খোঁজ লইবার রীতি বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। আশঙ্কা ছিল, কোন জাতিবর্ণের কত মানুষ বাস করিতেছেন, কোথায় কাহার সংখ্যা তথা গুরুত্ব কী হারে বাড়িতেছে বা কমিতেছে, এই সকল তথ্য প্রচারিত হইলে তাহা সমাজে জাতপাতের বিভাজন বাড়াইবে, বিভাজনের রাজনীতিকে উৎসাহিত করিবে। তথ্য ‘গোপন’ রাখিয়া বিভাজন রোধ করিবার এই বুদ্ধি বাস্তবে কতটুকু কার্যকর হইয়াছে, গত আট দশকের ইতিহাস তাহা জানাইয়া দেয়। জাতি বা ধর্মের মতো বিষয়গুলি এ দেশে ব্যক্তি-পরিচিতির প্রাসঙ্গিক ও বহুব্যবহৃত অঙ্গ, সুতরাং তাহা জানা এবং জানানো দরকার।
কিন্তু বিপদ ঘটে, যখন কোনও একটি বা নির্দিষ্ট কিছু পরিচয়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়া ব্যক্তি তথা গোষ্ঠীকে সেই খণ্ডিত পরিচিতির ছকে বাঁধিয়া দেখা হয়। এই মুহূর্তে সেই বিপদের কিছু দুর্লক্ষণ দেখা যাইতেছে। ২০১১ সালের জনশুমারিতে নাগরিকদের ধর্মীয় পরিচিতির যে হিসাব মিলিয়াছিল, তাহা সদ্য প্রকাশিত হইয়াছে। বিহারে অদূরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে ধর্মীয় পরিচিতিভিত্তিক বিভাজনকে হাতিয়ার করিবার দুরভিসন্ধি হইতেই এই সময় রিপোর্টটি ‘ফাঁস’ করিবার সিদ্ধান্ত— কেন্দ্রীয় শাসক দলের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠিয়াছে। অভিসন্ধি জল্পনার বিষয়। ঘটনা ইহাই যে, এই রিপোর্টে জনবিন্যাসে কোনও অস্বাভাবিক পরিবর্তনের লক্ষণ নাই, যাহা প্রত্যাশিত ছিল, তাহারই স্পষ্ট সমর্থন আছে। আর্থিক অবস্থা, শিক্ষা, বিশেষত স্ত্রীশিক্ষা এবং জনস্বাস্থ্য, বিশেষত মেয়েদের স্বাস্থ্য, এই বিষয়গুলিতে উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়া আসে— বিশ্বব্যাপী বহুলপ্রমাণিত এই সত্যই আরও এক বার ভারতীয় জনশুমারির পরিসংখ্যানে প্রতিফলিত। ‘মুসলিম জনবিস্ফোরণ হইতে সাবধান’ বলিয়া পাড়া মাথায় করিবার শোরগোল সম্পূর্ণ নির্বোধ। ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রতি এই জনশুমারির নির্দেশ একটিই: উন্নয়ন, উন্নয়ন এবং উন্নয়ন।