অপরিহার্য? আমাদের কয়লা আছে, ব্যবহার না করে উপায় কী? ছবি: গেটি ইমেজেস
বিশ্ব উষ্ণায়নের মোকাবিলায় আমেরিকা ও চিন কত দূর কী করবে সে বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। (‘উষ্ণায়নের বিপদঘণ্টা...’, ৭-১ ও ‘বাঁচবে গবু...’, ৪-২) আমেরিকায় আসন্ন নির্বাচনের পরে কোনও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী যদি প্রেসিডেন্ট হয় আর এই পার্টি যদি সেনেট এবং হাউসে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় তা হলে আশা করা যায় যে তারা এ বিষয়ে সক্রিয় থাকবে। তা যদি না হয়, তা হলে নতুন আইন পাশ করা অসম্ভব হবে। চলতি আইনে কিছু কাজ করা যাবে কিন্তু তা যথেষ্ট হবে না। চিন মনে হয় তার ঘোষণা অনুযায়ী কাজ করে যাবে। কিন্তু আর্থিক সঙ্কট কত দ্রুত কাটে, তার উপর নির্ভর করবে তার ভবিষ্যৎ কর্মসূচি।
এই দুই দেশ ছাড়াও যারা রাষ্ট্রপুঞ্জের আলোচনায় নেতৃত্ব দিয়েছে তারা হল ইউরোপ, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত। কিয়োটো সমঝোতার সময়ে তো বটেই, তার পরেও ইউরোপ খুবই সক্রিয় ছিল। চিনের মতো ইউরোপও জ্বালানির জন্য আমদানিনির্ভর। ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাস আসে রাশিয়া ও আফ্রিকা থেকে। তাই জ্বালানির খরচ কমাতে আর সৌর বা বায়ু বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে ইউরোপ সব সময়েই প্রস্তুত ছিল। পরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যসংখ্যা বেড়ে যায়। তার সঙ্গে বাড়ে আর্থিক সমস্যা। সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে আসা ক্রমেই কঠিন হয়। মূলত এই কারণে আর আলোচনাসভায় নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব হয় না। ইউরোপ যদিও ঘোষণা করেছিল যে, অন্যেরা সঙ্গে থাকলে তারা নিঃসরণ দ্রুত কমিয়ে আনতে রাজি, সে কথায় কোনও কাজ হয়নি।
১৯৭০-এর দশক থেকে ব্রাজিল গাড়িতে পেট্রলের পরিবর্তে ইথানল ব্যাবহার করছে। যানবাহন থেকে নিঃসরণ তাই কম। ব্রাজিলের সমস্যা হল বন সংরক্ষণ। প্রতি বছর ব্রাজিলে লক্ষ লক্ষ একর জঙ্গল কেটে সাফ করা হচ্ছে। এই জঙ্গল বাতাস থেকে যে পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নিতে পারত, তা বাতাসেই থেকে যাচ্ছে। ব্রাজিল অবশ্য বলেছে যে তারা এটা বন্ধ করবে। দক্ষিণ আফ্রিকা কয়লা প্রধান দেশ। অস্ট্রেলিয়ার মতো তারাও কয়লা রফতানি করে। স্বভাবতই এ দেশে কয়লা থেকেই বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। নিঃসরণ সেই কারণে বেশি, মাথাপিছু চার টনের উপর। এই দেশও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে নিঃসরণ কমাবার।
ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রভাব সীমিত তাদের প্রতিবেশী দেশের মধ্যে। সে তুলনায় ভারতের প্রভাব অনেক সুদূরপ্রসারী। পণ্ডিত নেহরুর সময় থেকেই ভারত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভায় নেতৃত্ব দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে আলোচনাসভাতেও কি ভারত সঠিক ভাবে নেতৃত্ব দিতে পেরেছে? এ ক্ষেত্রে আমাদের একটা বাস্তব অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ভারতের মাথাপিছু নিঃসরণ খুবই কম— বছরে মাত্র ১.৭ টন, যেখানে বিশ্বের গড় ৫ টন। ভারতের জনসংখ্যা বেশি। তাই আমাদের মোট নিঃসরণ বেশি। কিন্তু মাথাপিছু নিঃসরণ কম হওয়াতে নিঃসরণ কমাবার সুযোগ আমাদের কম। বারে বারেই আমাদের বলতে হয়েছে, নিঃসরণ আরও কমাতে আমরা অক্ষম। অনেকে ভুল বুঝেছে। ভেবেছে এরা নিজেরা কিছু করবে না, শুধু অন্যদের জ্ঞান দেবে।
আত্মপক্ষ সমর্থনে আমরা কী যুক্তি দিয়েছি? কিয়োটো সমঝোতায় বলা ছিল, উন্নত দেশগুলিকে নিঃসরণ কমাবার লক্ষ্য নিতে হবে, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলিকে কোনও লক্ষ্য নিতে হবে না। ১৯৯২ সালের এই নিয়মটি আমরা এখনও প্রাণপণ আঁকড়ে আছি। কিয়োটোতে নেওয়া লক্ষ্যমাত্রা ছিল খুব সামান্য। উন্নত দেশগুলিকে বলা হয়েছিল ১৯৯০-এর তুলনায় ২০১২-র মধ্যে নিঃসরণ গড়ে ৫ শতাংশ কমাতে। এটা ছিল নেহাতই পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ, তাই উন্নয়নশীল দেশগুলিকে এর আওতায় আনা হয়নি। ইতিমধ্যে পরিস্থিতি বদলেছে। নিঃসরণ কমানো এখন অনেক বেশি জরুরি, তাই সব দেশকেই বলা হয়েছে নিঃসরণ কমাতে। উপরন্তু ১৯৯২ সালের ভারত আর আজকের ভারত এক নয়। সবাই জানে আমরা উঠতি সুপারপাওয়ার। তাই কুড়ি বছর আগেকার ওই নিয়মের প্রতি আমাদের আনুগত্য কেউ ভাল চোখে দেখেনি। জয়রাম রমেশ চেয়েছিলেন ভারতের অবস্থান একটু নরম করতে। কিন্তু তিনি কারও সমর্থন পাননি।
আমরা আরও বলেছি, দেশের গরিব মানুষের স্বার্থে আমাদের চাই আর্থিক বিকাশ। তার জন্য প্রয়োজন আরও বিদ্যুৎ উৎপাদন। কয়লা ছাড়া আমাদের গতি নেই তাই আমাদের নিঃসরণ আপাতত বাড়বে। দরিদ্রনারায়ণের নামে এই আবেদনে চিঁড়ে ভেজেনি। আমাদের দেশে গরিব মানুষের যত কদর, বাইরে তার ছিটেফোঁটাও নেই। বিশ্ব বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের 'দোহা ডেভেলপমেন্ট রাউন্ড'-এর উপর যাঁরা নজর রেখেছেন তাঁরা দেখে থাকবেন এই একই পরিণতি। বরঞ্চ ছোট দ্বীপগুলি বলার সুযোগ পেয়েছে যে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন, জলে ডুবতে বসেছি, আর তোমরা উন্নয়নের কথা বলছ? তোমাদের সেই চুঁইয়ে-পড়া উন্নয়ন?
সৌর বিদ্যুতের চড়া দাম সত্ত্বেও আমরা ঘোষণা করেছি, ২০২২-এর মধ্যে ১ লক্ষ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপন্ন করব। এ জন্য আমাদের বিশ্বের কৃতজ্ঞতা অর্জন করা উচিত ছিল। কিন্তু প্রশ্ন উঠল, এই কর্মসূচি যদি নিতে পারি তবে লক্ষ্যমাত্রা নিতে আপত্তি কেন? সদুত্তর না পেয়ে অনেকেই বিভ্রান্ত। প্রশংসা না করে উলটে কয়লার ব্যবহার কমছে না বলে নিন্দা করেছে। প্যারিস সম্মেলনের আগে আমেরিকার বিদেশ সচিব জন কেরি বলতে পেরেছেন প্যারিসে ভারতই হল প্রধান চ্যালেঞ্জ। অর্থাৎ যাদের লাগামছাড়া বিলাসিতার জন্য দেশে মাথাপিছু নিঃসরণ বছরে ১৯ টন, তারা সমস্যা নয়, সমস্যা আমরা! তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ।
আমরা বুঝিনি তাই বোঝাতেও পারিনি যে ভারত নিঃসরণ কমালেও লাভ হবে না, যতক্ষণ না আমেরিকা আর চিন নিঃসরণ কমাচ্ছে। এটা করব না সেটা পারব না না বলে আমাদের বলা উচিত ছিল পেট্রল আর কয়লার ব্যবহার কমাতে আমরা আগ্রহী। উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলিকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। আমরা খোঁজ রাখছি এ ব্যাপারে তারা কতটা এগোল। নজর রাখছি আমেরিকার উপর, যেখানে জ্বালানির ব্যবহার আমাদের অনেক গুণ বেশি। যে দিন দেখব আমেরিকায় জ্বালানির ব্যবহার সত্যিই কমছে, সেই দিনই আমরা নিঃসরণ কমাবার দিনক্ষণ ঘোষণা করে দেব।
ভূতপূর্ব মুখ্যসচিব, পশ্চিমবঙ্গ সরকার