সম্পাদকীয়

অন্যমোনা

এই বার এক পণ্ডিত বলিলেন, মোনা লিসা এক চিনা ক্রীতদাসী এবং লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চির মাতা। চিত্রটিতে দৃশ্যমান নিসর্গও চিন দেশের প্রকৃতিদৃশ্য। বস্তুত এই চিত্রটি লইয়া নানাবিধ অনুমান ও চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত জানাইবার এক ঐতিহ্যই প্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে। চিত্রটি অঙ্কিত হয় ১৫০৩ হইতে ১৫০৬ সালের মধ্যে, কিন্তু সহসা প্রবল জনপ্রিয় হইয়া উঠে বিংশ শতাব্দীতে, যখন ইহা চুরি যায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share:

এই বার এক পণ্ডিত বলিলেন, মোনা লিসা এক চিনা ক্রীতদাসী এবং লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চির মাতা। চিত্রটিতে দৃশ্যমান নিসর্গও চিন দেশের প্রকৃতিদৃশ্য। বস্তুত এই চিত্রটি লইয়া নানাবিধ অনুমান ও চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত জানাইবার এক ঐতিহ্যই প্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে। চিত্রটি অঙ্কিত হয় ১৫০৩ হইতে ১৫০৬ সালের মধ্যে, কিন্তু সহসা প্রবল জনপ্রিয় হইয়া উঠে বিংশ শতাব্দীতে, যখন ইহা চুরি যায়। ১৯১১ সালে ঘটনাটি ঘটে, ছবিটি ফিরিয়া পাওয়া যায় দুই বত্‌সর পরে, ইহার পর হইতেই মোনা লিসার পূজা, বিজ্ঞাপনে তাহার ব্যবহার, তাহাকে লইয়া রসিকতা, সকলই এমন পর্যায়ে বৃদ্ধি পায়, ইহা পৃথিবীর সর্বাধিক আলোচিত ছবি হইয়া উঠে। মোনা লিসার ইতিহাস খনন শুরু হয় এবং কেহই কোনও বিষয়ে একমত হইতে পারে না। ইহা কাহার প্রতিকৃতি তাহা পূর্বে স্পষ্ট ছিল, এই বার বহু নাম উঠিতে-পড়িতে থাকে। কেহ বলেন, ইহা লিয়োনার্দোর আত্মপ্রতিকৃতি! লিয়োনার্দো ইহা কবে আঁকিয়াছিলেন, কত সময় লইয়াছিলেন, কে বরাত দিয়াছিলেন, যদি ইতালীয় কেহ বরাত দেন তবে শিল্পী ছবিটি লইয়া ফ্রান্সে আসিলেন কেন, কী উপায়েই বা এইটি ফরাসি রাজবংশের হস্তগত হইল, সমস্ত লইয়া সহস্র তত্ত্বের বন্যা ডাকিয়া যায়। কেহ বলেন, ছবিটি দেখিলে বুঝা যাইতেছে মহিলা বধির, কেহ বলেন, দন্তহীন। মহিলাকে শোকগ্রস্ত, যৌনকর্মী, সিফিলিস-রোগী, প্যারালিসিস-আক্রান্ত, বা শিল্পীর স্নায়ুরোগের প্রতীক বলিয়াও ডাকা হয়। ফ্রয়েড এক গ্রন্থে অনুমান করেন, মহিলা লিয়োনার্দোর মাতা। তাঁহাকে চিনা বলিয়া দাবিও পূর্বে করা হইয়াছে। সম্প্রতি এই দুইটি মিলাইয়া নব হইহই উত্‌পাদন হইল মাত্র।

Advertisement

প্রশ্ন হইল, একটি চিত্র ভাল না মন্দ, ইহা বুঝিতে গেলে এক রসিকের কী কী জানা প্রয়োজন। আসল উত্তর হইল, কিচ্ছু না জানিয়া, চিত্রটিকে সত্‌ ও সম্পূর্ণ অভিনিবেশ সহকারে নিরীক্ষণ ও সম্যক ভাবে অনুভব করিবার প্রয়াস প্রয়োজন। কিন্তু কিছু পণ্ডিত ঠিকুজিবিলাস আনিয়া শিল্পের তরঙ্গকে ক্রমাগত ঘোলাটে করিয়া তুলিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথ কবিতাটিতে কী বুঝাইতে চাহিয়াছেন তাহা কবিতাটি মন দিয়া পড়িয়া শব্দ পংক্তি চিত্রকল্প হইতে বাহির না করিয়া, দলে দলে লোক ঝাঁপাইয়া নথি ঘাঁটিতেছেন, লেখাটি কবি সকালে লিখিয়াছিলেন না সন্ধ্যা ছয় ঘটিকায়, শিলাইদহের বোটে বসিয়া না সাজাদপুরের বাতায়নে, সন্তানের মৃত্যুর পরে না ভ্রাতৃবধূ ছাদে শাড়ি মেলিবার কালে, তখন মৃদুমন্দ বায়ে কবির শ্মশ্রু ডাইনে উড়িতেছিল না বামে। এই ইতিহাস কী কাজে লাগিবে? পণ্ডিত বলিবেন, বাস্তব উপাদানগুলি জানা থাকিলে শিল্পের অর্থ ও ব্যঞ্জনা স্পষ্টতর হইবে। আসল কথা হইল, ইহাতে গল্প জমিবে। শিল্পীর প্রেম, যৌনতা, হতাশা, সীমাবদ্ধতা লইয়া কিসসা, চুটকি, গসিপ গজাইবে। এই প্রক্রিয়ায় শিল্পবস্তুটিকে ক্রমশ ঠেলিয়া পিছনে সরাইয়া দেওয়া হইবে, শিল্পীর ব্যক্তিজীবন সম্মুখে চলিয়া আসিবে, অবান্তর অনুপুঙ্খ আসিয়া শিল্পভোগটিকে অস্বচ্ছ, কন্টকিত করিয়া তুুলিবে। শিল্প এমন কোনও নিয়ম মানিয়া সৃষ্টি হয় না যে টেবিল বা ক্যানভাসের পারিপার্শ্বিক তাহাকে অবধারিত ভাবে প্রভাবিত করিবে। শিল্পী স্বয়ং জানেন না তিনি পরিচিত মহিলার কথা লিখিতেছেন না গতকল্যের স্বপ্ন-নারীর, চিত্রকর জানেন না তাঁহার তুলি সহসা পথ বদলাইল ব্যাকরণের টানে না অবচেতন বিদ্বেষে। কাঁচামালের তালিকা প্রস্তুত করিলেই অন্তিম শিল্পবস্তুটিকে স্পর্শ করা যাইবে, ইহা ভাবিতে গেলে শিল্পের আত্মা সম্পর্কে অজ্ঞ বা অশ্রদ্ধাশীল হইতে হয়। মোনা লিসা চিনা হইলেও ছবিটি যাহা, বাঙালি হইলেও তাহাই। কালিদাস যখন মেঘদূত লিখিতেছিলেন, তাঁহার মেজাজ কেমন ছিল ও বাম পদে বৃশ্চিক দংশন করিয়াছিল কি না, তাহা জানা নাই বলিয়া আমাদের শ্লোক-রসগ্রহণের এক কণাও ইতরবিশেষ হয় কি? পণ্ডিতরা এই প্রবণতা ছাড়িলে, মোনা লিসা ও চিনা ক্রীতদাসী, উভয়েই শান্তিতে থাকিতে পারেন।

য ত্‌ কি ঞ্চি ত্‌

Advertisement

কলকাতার রাস্তায় এক মিনিবাস-চালককে দিব্যি গণধোলাই দিয়ে খুন করা হচ্ছিল, এক মহিলা প্রতিবাদ করে তাকে বাঁচালেন। কেন? গণতন্ত্রে গণধোলাই জন্মগত অধিকার! আমরা আইন হাতে নেব, বিচার করব, ডাইনি বা মোবাইল চোরকে পিটিয়ে মারব, রাজনীতির দলাদলিতে ডেলি বহুত খুন হবে, সকালে কাগজে তা পড়ে রক্তে আঁচাব। রাত্রে সিরিয়ালে ঘনঘোর চক্রান্ত আর নিরীহকে সমষ্টিগত অত্যাচারের নোংরামি চাখব। তবে তো সিগনাল থেকে উত্‌সারিত গান সার্থক হবে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement