Rabindranath Tagore

চোখের ঠুলি কবে খুলবে

শত শত বছর ধরে সংহিতার নির্দেশ মেনে ভারতের সমাজের মন গড়ে উঠেছিল, ব্রিটিশ আইন ও শাসন সে ধারণায় একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।

Advertisement

কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২০ ০২:০৩
Share:

প্রতীকী চিত্র।

কলুর বলদকে কেউ কখনও ক্ষিপ্ত হয়ে বাঁধন ছিঁড়ে তাণ্ডব বাধিয়ে দিতে দেখেনি। সে হয়তো নিজের কর্তব্যবোধ, শ্রমদান ও প্রভুদত্ত আহার্যের বরাদ্দে তৃপ্ত। তবে তার চোখ বাঁধা ঠুলি দু’টি খুলে দিলে কী হত বলা মুশকিল। পৃথিবীর অনেক পথ পাড়ি দিয়ে, অনেক রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে দিনের পর দিন, একই বৃত্তে কেউ তাকে ঘুরতে বাধ্য করছে, এই সত্য জানামাত্র সে যে বিদ্রোহ করত না, কে বলতে পারে? তাই কলু কিছুতেই বলদের চোখের ঠুলি খুলে দেওয়ার ঝুঁকি নিতে পারে না।

Advertisement

ঠুলি কি আমাদেরও চোখে নেই? স্বাধীনতার পরে আমরা জেনেছি কত সরকারি পরিকল্পনার কথা। দশকের পর দশক সে সব নিয়ে কত হইচই। তার কল্যাণে বিত্তে-বৈভবে স্ফীতও হয়েছেন অনেকে। কিন্তু, সমাজব্যবস্থার তাতে কতটুকু বদল ঘটেছে? মানুষের হৃদয়ের দারিদ্র ঘুচেছে কতটুকু, সে গোপন গভীর সংবাদটি নিয়েছে কেউ? সামাজিক ন্যায়ের মঙ্গলহস্ত কি সবার জন্য সমান দরদে প্রসারিত?

এই প্রশ্ন যখন কারও মনকে বিদ্ধ করে, সে আর স্থির থাকতে পারে না। ছুটে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে, সব ভয়কে তুচ্ছ করে। মধ্যরাতে সরকারি উর্দিধারীকে প্রায় আর্তনাদের ভঙ্গিতে বলে সে: ইয়ে ক্যা জ্বল রহা হ্যায়? তখন উচ্চবর্ণের চার যুবকের নৃশংস নির্যাতনে অকালমৃতা এক দলিত কন্যার লাশ পরিবারের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনে ডিজ়েল ঢেলে পোড়ানো হচ্ছে। প্রভুর আজ্ঞাবহ ‘ন্যায়ের প্রহরী’ জবাব দেয়, আমার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, তোমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া নয়।

Advertisement

সেই মেয়ে যদি হত উচ্চবর্ণের? বিত্তবান প্রভাবশালী ঘরের কন্যা? ঘটতে পারত তার উপরে অমন বীভৎস অন্যায়? ঘটলেও তার মৃতদেহ অমন ভাবে ছিনিয়ে এনে মধ্যরাতে জ্বালিয়ে দেওয়া যেত? পরিবারটিকে হুমকি দেওয়া যেত কি: বয়ান বদল করো, সংবাদমাধ্যম বেশিক্ষণ থাকবে না, আমরা থাকব। সেই রাতে শুধু দলিত মেয়েটির দেহ জ্বালানো হয়নি, জ্বালানো হয়েছে সংবিধান, নাগরিকের মৌলিক অধিকার, গণতন্ত্রের সমস্ত প্রতিশ্রুতি।

শত শত বছর ধরে সংহিতার নির্দেশ মেনে ভারতের সমাজের মন গড়ে উঠেছিল, ব্রিটিশ আইন ও শাসন সে ধারণায় একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। অন্ত্যজদের মধ্যে জাগ্রত হয় গণতান্ত্রিক চেতনা ও সমানাধিকারের দাবি। দেশ ভাগ হওয়ার মুহূর্তে তাঁরাও ভেবেছিলেন অস্পৃশ্য তথা শূদ্রদের স্বতন্ত্র ভূমি চেয়ে নেবেন, শেষ পর্যন্ত সে দাবি থেকে সরে এসে সকলের সঙ্গে মিলে নতুন ভারত গঠনের স্বপ্ন দেখেন। সদ্য-স্বাধীন দেশে জাতীয় নেতৃবৃন্দও মধ্যযুগীয় মনুবাদে ফিরে না গিয়ে গণতন্ত্রের আধুনিক পন্থায় সকলের সমানাধিকার ও বঞ্চিতদের জন্য রক্ষাকবচের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নতুন সংবিধান রচনা করেন। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন এই প্রতিশ্রুতিই যথেষ্ট। কেউ কেউ যে অন্য রকমও ভেবেছিলেন, বাবাসাহেব অম্বেডকরের ভাষ্যই তার দৃষ্টান্ত।

‘সমুদ্র যাত্রা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমাদের সমাজ বদ্ধ সমাজ’। লিখেছেন, “আমাদের সমাজ জীবন্ত নহে, তাহার হ্রাসবৃদ্ধি পরিবর্তন নাই, তাহা সুসম্বন্ধ, পরিপাটি প্রকাণ্ড জড় অট্টালিকা। তাহার প্রত্যেক কক্ষ পরিমিত, তাহার প্রত্যেক ইষ্টক যথাস্থানে বিন্যস্ত।” ওই অট্টালিকার প্রতি অবিচল ভক্তি নিয়ে আমরা নিজের নিজের কুঠির মধ্যে বদ্ধ আছি। মাঝে মাঝে বাইরে বেরোলেও কুঠির অভ্যাস ও সংস্কারকে চিন্তায় ও আচরণে বেঁধে নিয়ে যাই। এ অভ্যাস এতই সহজাত যে, কারও লজ্জা বা কুণ্ঠা বোধ হয় না। আমরা বদ্ধতা বাইরে খুঁজি, মনের ভেতরে খুঁজি না। সংস্কারের নাগপাশ ও মনুবাদী মূল্যবোধ কী ভাবে অধিকাংশের চিত্তবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে, খুব কম মানুষই সেটা বুঝে উঠতে পারেন।

বহিষ্কৃত সমাজ বা বহিরাগত কোনও ব্যক্তির পক্ষেই শুধু তা সহজে বোঝা সম্ভব। ফাদার দ্যতিয়েন তাঁর ‘রোজনামচা’য় রসিকতার ছলে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীতে এক বিয়ের নিমন্ত্রণে অর্জিত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন: আশীর্বাদককে সলজ্জ ভঙ্গিতে প্রণাম করে মেয়েটি বলেছিল, ‘খেয়ে যাবেন কিন্তু…’। বলেছিলাম, ‘আচ্ছা’।… তার এক কাকা আমার ভার নিলেন, বললেন, ‘আসুন… আপনার জন্য অন্য বন্দোবস্ত আছে।… দেখি, লোকটি আমাকে ভাণ্ডারের এক কোণে বসিয়েছেন স্কুলের মেথরের মুখোমুখি।” ফাদার লিখেছেন, “লজ্জাবোধ করিনি: মেথর ছেলেটি আমার অনেকদিনের বন্ধু।”

কী অসম্ভব কথা! মেথর কখনও কারও বন্ধু হয়? সে তো অস্পৃশ্য, সমাজ থেকে বহিষ্কৃত। তার নিরলস শ্রমটুকুই শুধু আমরা চাই, তাকে তো চাই না। আমাদের বদ্ধ ঘরে ও জীবনে কোনও অস্পৃশ্যের ঠাঁই নেই। এই যে অস্পৃশ্যতার বোধ ও অনুভব, এটাও আমরা আমাদের সমাজ থেকে পেয়েছি। আমরা যে বদ্ধ সমাজের বাসিন্দা আগে তা উপলব্ধি করতে হবে, তবেই জাগবে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। সাম্যের অনুকূলে তৈরি করতে হবে নিজের মনকে। গণ-কে ভাল না বেসে গণতন্ত্রকে ভালবাসা যায় না। মনুতন্ত্র যাদের অধিকার কেড়ে নিয়ে অবমানব করে রেখেছিল, গণতন্ত্রের কাজ সর্বাগ্রে তাদের অধিকার ও মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া। তা করতে গেলেই প্রাচীন শোষকরা আসরে নেমে পড়ে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরাও অন্যায়ের পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠেন।

আর তখন, নিকষ অন্ধকারে, ক্ষীণ আশার আলো হয়ে জেগে থাকে ওই চিৎকার: ইয়ে ক্যা জ্বল রহা হ্যায়’! ক্ষমাহীন অপরাধে লিপ্ত শক্তিধর রাষ্ট্রযন্ত্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক সাহসিনী যেন সমগ্র ভারতের প্রতিনিধি হয়ে জবাব চায়: বলো, কাকে জ্বালিয়ে দিয়েছ তোমরা? এই প্রতিবাদী আর্তি যদি এক সহ-নাগরিকের জন্য আর এক সহ-নাগরিকের কণ্ঠে ধ্বনিত না হত, বিশ্বাস করার কারণ ছিল যে, ভারতের বিবেক ও চৈতন্যের মৃত্যু হয়েছে। মিথ্যা স্বপ্নে কলুর বলদেরা হয়তো আরও অনেক কাল ঘুরতে থাকবে, আমাদের কাজ হোক তাদের চোখের আবরণ ও গলার বাঁধনটি খুলে দেওয়া।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement