পার্থ চট্টোপাধ্যায় যতই ‘ধমকান-চমকান’, জয়পুরিয়া বা বিদ্যাসাগর কলেজ প্রমাণ করিল, ছাত্র-রাজনীতি বদলায় নাই। অবশ্য, ইহাকে ‘রাজনীতি’ বলা চলে কি না, তাহা ভিন্ন তর্ক। অভিযোগ, বিরোধীদের সহিত নহে, সংঘর্ষ চলিতেছে শাসক দলেরই বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরে, রাজ্যের বৃহত্তর পরিসরে, এলাকা দখল লইয়া যে সংঘাতের খবর নিয়মিত আসে, কলেজের সংঘাতের চরিত্রও তাহারই ন্যায়। কলেজের ক্ষমতার রাশটি কাহার হাতে থাকিবে, সেই দ্বন্দ্বেই কলেজগুলি রণক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছে। সম্প্রতি কলেজে ভর্তি করাইয়া দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়া প্রভূত টাকা আদায়ের যে বিপুল ও ব্যাপক প্রথা জনসমক্ষে আসিয়াছে, এলাকা দখলের লড়াইয়ে তাহার ভূমিকা অনস্বীকার্য। অনুমান করা চলে, কলেজগুলিতে এখন টাকা উড়িতেছে। নবীনবরণ বা ফেস্ট আয়োজনের খুচরা টাকা নহে, প্রভূত পরিমাণ টাকা। সেই টাকায় অধিকার কায়েম করিবার একমাত্র উপায় কলেজে রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করা। অতএব, শিক্ষামন্ত্রী, এমনকী মুখ্যমন্ত্রীও, যাহাই বলুন না কেন, পশ্চিমবঙ্গের কলেজগুলি এই পথেই চলিবে। তাহার একটি উপজাত সমস্যাও আছে। যেহেতু এই দখলের রাজনীতির দৌলতে ছাত্র-রাজনীতি মূলত অনৈতিকতা ও হিংসার পরিসর হইয়া উঠিয়াছে, ফলে যেখানে প্রত্যক্ষ ভাবে দখলের প্রশ্ন নাই, সেখানেও হিংসা আছে। শিক্ষকদের বন্দি করিয়া রাখা, অধ্যক্ষকে হেনস্তা করা— সার্বিক ভাবে ছাত্রসমাজের শৃঙ্খলাহীনতাকে ‘স্বাভাবিক’-এর স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে এই আচরণগুলি স্বাভাবিক, বস্তুত অনিবার্য, হইয়া উঠিয়াছে।
সমাধানের একটিমাত্র পথ আছে। ছাত্র-রাজনীতি হইতে রাজনৈতিক রংকে সম্পূর্ণ ভাবে বর্জন করা। ছাত্র সংগঠনগুলিকে শুধু খাতায়-কলমে রাজনৈতিক দল হইতে বিচ্ছিন্ন করিলেই হইবে না। সত্যই যেন কোনও সংযোগসূত্র না থাকে, তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে। গত কয়েক বৎসরে ক্রমে সেই পথে যাত্রাও আরম্ভ হইয়াছে। ধীর লয়ে, কিন্তু অভিমুখটি অনস্বীকার্য। ছাত্র সংসদের পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে হইলে ক্লাসে উপস্থিতি, পরীক্ষায় নম্বর ইত্যাদির কথা বলা হইতেছে। বৎসরের পর বৎসর বিভিন্ন বিষয়ের কোর্সে ভর্তি হইয়া ছাত্র থাকিয়া যাইবার প্রবণতাটিরও রাশ টানা হইতেছে। কিন্তু, রাজনৈতিক দলগুলির সহিত ছাত্র-রাজনীতির সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ না হইলে এই পরিবর্তনগুলি অর্থহীন হইবে। কারণটি সহজবোধ্য। কলেজে যে ছাত্ররা আইন ভাঙিতেছে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিতেছে, তাহারা বিলক্ষণ জানে, বিপদে পড়িলে উদ্ধার করিবার লোক আছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ দূরে থাকুক, পুলিশ বা প্রশাসনেরও তাহাদের কেশাগ্র স্পর্শ করিবার সাধ্য হইবে না। পিছনে রাজনৈতিক দলের সমর্থন না থাকিলে এই ছাত্ররা প্রশাসনকে সমঝিয়া চলিবে। রাজনৈতিক রংহীন ছাত্র রাজনীতি কেমন হইতে পারে, তাহার উদাহরণও পশ্চিমবঙ্গেই আছে। জয়পুরিয়া-বিদ্যাসাগরের সহিত সেন্ট জেভিয়ার্সের ফারাক আলাদা করিয়া দেখাইয়া দিতে হয় না। বস্তুত, রাজনীতি সরিয়া দাঁড়াইলে টাকার খেলাও কমিবে। কলেজের পরিসরটিকে কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হইবে। প্রশ্ন হইল, পার্থবাবুরা কি এই ঝুঁকি লইতে প্রস্তুত?