গৈরিকস্তানে সঙ্কট

বাস্তবিক, সরকারে যখন নিজেদের দলই আসীন থাকে, কিন্তু অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে কিছুতেই অগ্রসর হওয়া যায় না, তখনই এত সব স্ববিরোধিতার প্রস্ফুরণ ঘটে। আরএসএস ও ভিএইচপির অবস্থান এবং গণতান্ত্রিক দেশের শাসক বিজেপির অবস্থানের মধ্যে দূরত্ব, এবং সেই দূরত্ব-প্রসূত রাজনৈতিক অস্পষ্টতা এখন কেবল সঙ্ঘীয় সমাজের ভিতরের কথা নহে, বাহির হইতেই তাহা দিব্য অনুভূত হইতেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৮ ০০:১৯
Share:

রবিবার অযোধ্যায় যে বিপুল রামভক্তবাহিনীর জমায়েত ঘটিল, নিজেদের গৈরিক মাহাত্ম্যে তাঁহারা নিজেরাই আত্মহারা না হইলে, আপনাপন ডেরায় ফিরিবার আগে গভীর সংশয়ে নিমজ্জিত হইতে পারিতেন। মঞ্চের চন্দনচর্চিত সাধুরা ঠিক কী বলিলেন? ভক্তদের কি আপাতত অপেক্ষা করাই কাজ, না কি অপেক্ষার বদলে হুঙ্কার ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরিই পরবর্তী কর্মসূচি? চিত্রকূটের রামভদ্রাচার্য প্রধানমন্ত্রী মোদীর ঘনিষ্ঠ বলিয়া দাবি করেন। তিনি বক্তৃতায় জানাইলেন ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার কী পদক্ষেপ করে দেখিবার জন্য ধৈর্য ধরিতে। এ দিকে সঙ্ঘশিরোমণি মোহন ভাগবত মন্তব্য করিয়াছেন, অনেক ধৈর্য ধরা হইয়াছে, আর নহে, এ বার আইন চাই। ভাগবতের মতোই অযোধ্যামঞ্চে উপবিষ্ট সাধুবর্গ জানাইলেন, সরকারকে আইন নয়তো অধ্যাদেশ আনিতেই হইবে, নতুবা...। নতুবা যে কী হইবে, আশ্চর্য ভাবে তাহা অনুচ্চারিত ও অনালোকিত থাকিয়া গেল। যতই গৈরিক-ত্রিশূল শোভিত হউন, আইন-অধ্যাদেশ তো রামভক্তরা আনিবেন না, দিল্লি দরবারে তাঁহাদের প্রতিনিধিদেরই তাহা আনিতে হইবে। সে ক্ষেত্রে সভাসমিতি নাগপুরে করিলেই হয়, অযোধ্যায় হট্টগোল তুলিয়া লাভ কী। জনৈক ভিএইচপি নেতার ঘোষণা, এই বারও মন্দির না হইলে বিজেপিকে বনবাস কেন, অজ্ঞাতবাসে যাইতে হইবে। সন্দেহ নাই, বিজেপির পক্ষে তাহা নিতান্ত সর্বোচ্চ শাস্তি, কিন্তু রামমন্দিরের ব্যবস্থা কি তবে অবিজেপি সরকার করিবে? হদিস মিলিল না!

Advertisement

বাস্তবিক, সরকারে যখন নিজেদের দলই আসীন থাকে, কিন্তু অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে কিছুতেই অগ্রসর হওয়া যায় না, তখনই এত সব স্ববিরোধিতার প্রস্ফুরণ ঘটে। আরএসএস ও ভিএইচপির অবস্থান এবং গণতান্ত্রিক দেশের শাসক বিজেপির অবস্থানের মধ্যে দূরত্ব, এবং সেই দূরত্ব-প্রসূত রাজনৈতিক অস্পষ্টতা এখন কেবল সঙ্ঘীয় সমাজের ভিতরের কথা নহে, বাহির হইতেই তাহা দিব্য অনুভূত হইতেছে। তিলকসিন্দূরচর্চিত শ্মশ্রুগুম্ফশোভিত গৈরিকপরিহিত ‘নেতা’দের হুঙ্কার শুনিয়া তাই এক দিকে যেমন বিপদের আশঙ্কায় শিহরিত হইতে হয়, অন্য দিকে মনে হয়, ভারতীয় সমাজ কোনও প্রহসনমঞ্চের দর্শক হইয়াছে। ইঁহারা কে, ইঁহাদের এত প্রতাপ কোথা হইতে জন্মিল, কোন অধিকারে ইঁহারা আসমুদ্রহিমাচল বিপুলা ভূমির অতিবৈচিত্রময় হিন্দু সমাজের প্রতিনিধি হইয়া বসিলেন— এই সব প্রশ্ন ধামাচাপা দিবার জন্যই সম্ভবত রামলালার জয়ধ্বনি এমন কর্ণপটহবিদারক।

এই স্ববিরোধিতার জন্যই বিজেপি প্রধানমন্ত্রী হইতে শুরু করিয়া মুখ্যমন্ত্রী, কাহারও কথায় আপাতত সামঞ্জস্য বা সঙ্গতি নাই। রামমন্দির হইবেই, বলিয়াছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। তবে কি সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত হইয়াও সর্বোচ্চ আদালতের বিরোধিতা করিতেই বলিতেছেন তিনি?— ঠিক যেমন বলিয়াছেন তাঁহার রাজ্যের বিজেপি বিধায়ক সুরেন্দ্র সিংহ? জানা নাই। প্রধানমন্ত্রী সৌভাগ্যবান, তাঁহাকে প্রশ্নের মুখোমুখি হইতে হয় না, নিজের সমর্থকদের প্রশ্নেরও না— তিনি একতরফা তাঁহার মনের কথা বলিতে পারেন। তবু তাঁহার সমর্থকসমাজ যখন মসজিদ-ধ্বংসের জমিতে মসজিদের জন্য এক চুল জমিও না ছাড়িয়া মন্দির বানাইবার কথা বলেন, তখন প্রধানমন্ত্রীর মুখে কেনই বা শোনা যাইবে, অন্যের অধিকারকে সম্মান করিতে শিখিলে তবেই নিজের অধিকার সুরক্ষিত হয়? ইহাকে রামের মুখে ভূতনাম বলিলে কি অত্যুক্তি হইবে? আসলে, বিরোধী দল হিসাবে মানুষ খেপাইবার আন্দোলন করা যত সহজ, শাসক হিসাবে ততটা নয়। শাসক হইয়া ভোটের জন্য বিভেদ-বৈষম্য প্রচারটিও অনেক সময় মন খুলিয়া করা যায় না। তাই, অযোধ্যাকাণ্ড হইতে যুদ্ধকাণ্ডে পৌঁছনো হয়তো এই বার সহজ হইবে না, মোদীরা ভাবিতেছেন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement