সুপ্রিম কোর্ট। —ফাইল চিত্র।
সাংবাদিকের ডিজিটাল সামগ্রী যথেচ্ছ বাজেয়াপ্ত করতে পারে না পুলিশ, জানিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট। কখন, কী শর্তে সেগুলি বাজেয়াপ্ত করা যেতে পারে, সে বিষয়ে রক্ষাবিধি প্রণয়নের নির্দেশও দিল। অর্থাৎ, আরও এক বার গণতন্ত্রের গোড়ার কথা প্রশাসনকে মনে করাতে হল শীর্ষ আদালতকে। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার, তার সুরক্ষা সরকারের কর্তব্য, অথচ, কোনও একটি তদন্তে নেমে সাংবাদিকদের ডিজিটাল সামগ্রীগুলি অকাতরে বাজেয়াপ্ত করে নানা তদন্তকারী দল। সম্প্রতি বিদেশি অর্থের বেআইনি ব্যবহারের অভিযোগের তদন্তে নেমে দিল্লি পুলিশ একটি সংবাদসংস্থার নব্বই জনেরও বেশি সাংবাদিকের থেকে অন্তত আড়াইশো ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, হার্ড ডিস্ক প্রভৃতি বাজেয়াপ্ত করেছে। এই ধরনের যন্ত্রে সাংবাদিকের কাজের সমস্ত নথিপত্র রক্ষিত থাকে, থাকে খবরের সূত্রগুলিও। সাংবাদিকের নানা ব্যক্তিগত তথ্যও এগুলিতে রাখা থাকে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা প্রতিটি নাগরিকের অধিকার। তদুপরি নীতিগত কারণে ও পেশাদারিত্বের প্রয়োজনে সাংবাদিককে সূত্রের গোপনীয়তা বজায় রাখতে হয়। অথচ, বাজেয়াপ্ত ডিজিটাল সামগ্রীতে রক্ষিত তথ্যভান্ডার থেকে তদন্ত সংস্থাগুলি কী নিষ্কাশন করছে, সেই সব তথ্য কী ভাবে ব্যবহার করতে পারে তারা, এর কিছুই স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন সাংবাদিকরা। একটি জনস্বার্থ মামলায় এক সাংবাদিক সংগঠনের আইনজীবী জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশের একশোরও বেশি সাংবাদিকের ডিজিটাল সামগ্রী রয়েছে বিভিন্ন তদন্ত সংস্থার কাছে। এই প্রেক্ষিতেই সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি ডিজিটাল সামগ্রীতে রক্ষিত তথ্যের রক্ষাবিধি তৈরি করতে নির্দেশ দেন কেন্দ্রীয় সরকারকে।
সাংবাদিকের তথ্যের গোপনীয়তা সম্পর্কে নানা সময়ে আদালতের নানা পর্যবেক্ষণ মিলেছে। এ বছরেরই গোড়ার দিকে দিল্লির এক আদালত মন্তব্য করে যে, তদন্তকারী সংস্থার কাছে খবরের সূত্র জানানো থেকে সাংবাদিকরা ছাড় পাবেন, এমন কোনও আইন নেই। তবে সুপ্রিম কোর্ট বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সূত্রের গোপনীয়তা বজায় রাখার প্রয়োজনকেই গুরুত্ব দিয়েছে। ২০২১ সালে ‘পেগাসাস’ সফটওয়্যারের অবৈধ ব্যবহারের মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলে যে, সাংবাদিকদের সূত্রের গোপনীয়তা রক্ষা করা দেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সুরক্ষার অন্যতম শর্ত। ৭ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে বিচারপতি সঞ্জয় কিশন কৌল বলেন, “সাংবাদিকদের নিজস্ব ‘সোর্স’ থাকে। গোপনীয়তার অধিকার কিন্তু মৌলিক অধিকার।” অর্থাৎ তাঁর পর্যবেক্ষণে সূত্রের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার বিবেচিত হয়েছে সাংবাদিকের মৌলিক অধিকারের প্রেক্ষিতে।
সুপ্রিম কোর্ট মনে করিয়েছে, রাষ্ট্র তদন্তকারী সংস্থার দ্বারা চালিত হতে পারে না। এই সতর্কবার্তায় কেন্দ্র কান দেবে, তার আশা কম। বিরোধীর প্রতি সরকারের ভীতিপ্রদর্শন, হয়রানি, অসার মামলায় অভিযুক্ত করে কারাবন্দি— এ সবই বহু দশক ধরে চলছে। তবে নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে সমালোচকদের উপর উৎপীড়ন এক অন্য পর্যায়ে চলে গিয়েছে। শতাধিক সাংবাদিকের ফোন, ল্যাপটপ বাজেয়াপ্ত করা বস্তুত দেশবাসীর প্রতি এক প্রচ্ছন্ন হুমকি। তা হল, স্বচ্ছতা ও ন্যায়ের প্রতি দায়বদ্ধ নাগরিক সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হতে চাইলে, নিজের বিবেক অনুসারে কাজ করলে, সহজেই তাকে চিহ্নিত করতে পারবে পুলিশ-প্রশাসন— সাংবাদিকের ফোনে আড়ি পেতে, না হলে ফোন বাজেয়াপ্ত করে। নানা ভাবে মৌলিক অধিকারের সুরক্ষার প্রশ্নটি অতিকায় হয়ে উঠছে। সাংবাদিকের ডিজিটাল সামগ্রীর সুরক্ষা তার একটি ক্ষুদ্র, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকারের প্রতি রাষ্ট্র যে সন্দিহান, শ্রদ্ধাশীল নয়, তা এক দুর্লক্ষণ। স্বৈরতন্ত্রেই এমন হয়, গণতন্ত্রে নয়।