প্রতীকী ছবি।
অতঃপর কলিকাতা ভেনিস হইল। গত সপ্তাহের অঝোর বর্ষণে কোথাও জল কোমর ছাড়াইল, কোথাও শয়নকক্ষ ভাসিল, কোথাও বাসিন্দারা জমা জলে ছিপ ফেলিয়া মাছ ধরিলেন। জল-যন্ত্রণা কলিকাতায় নূতন নহে। আষাঢ়ের প্রথম দিনটি হইতে শহরবাসী জল জমার উদ্বেগে ভুগিতে থাকেন। এই বৎসরও বর্ষা সেই উদ্বেগ হইতে রেহাই দিল না। নিঃসন্দেহে গত সপ্তাহের বৃষ্টির পরিমাণ অধিক ছিল। কয়েক ঘণ্টায় যে পরিমাণ বৃষ্টি হইয়াছিল, তাহাতে নিচু জায়গায় জল জমা অস্বাভাবিক নহে। সমস্যা হইল, বৃষ্টি থামিবার পরও বহু এলাকা হইতে জল নামে নাই। ইহার ব্যাখ্যা অবশ্য মিলিয়াছে পুরসভার তরফে। জোয়ারের কারণে সেই সময় ছয়টি লকগেট বন্ধ ছিল। তাই জল দ্রুত সরিতে পারে নাই। সঙ্গে সাফাইও শুনা গিয়াছে— অল্প সময়ের মধ্যে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হইয়াছে, সেই পরিমাণ জল সরাইবার ক্ষমতা পুরসভার নাই।
কেন নাই? কেন এক সপ্তাহ কাটিবার পরও বেশ কিছু স্থান জলমগ্ন থাকিবে? অনস্বীকার্য যে, বর্ষায় জলমগ্ন কলিকাতার পুরাতন চিত্র সম্প্রতি উন্নত হইয়াছে। এক সময় অল্প বৃষ্টিতেও কলিকাতার বেশ কিছু স্থানে নৌকা ভাসাইতে হইত। সেই পরিস্থিতি এখন নাই বটে; কিন্তু উন্নতির পরিমাণ যত হওয়া উচিত ছিল, ঠিক ততও হয় নাই। প্রতি বৎসর একটি কথা পুর প্রশাসনের মুখে শুনা যায়, আগেও যাইত— কলিকাতার আকৃতি গামলার ন্যায়। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই জল জমা স্বাভাবিক। কথাটিতে ভুল নাই। কিন্তু তদনুসারে পদক্ষেপ করা এত দিনেও সম্ভব হইল না কেন? কেন কলিকাতার উত্তর ও দক্ষিণে বেশ কিছু স্থানে জল জমিবার সুদীর্ঘ ইতিহাস থাকিলেও সেইখানে অতিরিক্ত সতর্কতা লওয়া হইল না? যথাসময়ে তৎপরতা যে দেখানো যায় নাই; কখনও অর্থাভাবে, কখনও উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাবে কাজে বিলম্ব হইয়াছে, সেই কথা পুর প্রশাসকমণ্ডলীর পক্ষ হইতেই বিভিন্ন সময় স্বীকার করিয়া লওয়া হইয়াছে। ত্রুটি রহিয়াছে নিকাশির কাজেও। গালিপিটে প্লাস্টিক জমিয়া থাকিবার কারণে জল নামিতে বিলম্ব হইতেছে। প্রশ্ন, প্লাস্টিক সরাইয়া নিকাশিব্যবস্থা মসৃণ রাখিবার কাজটি সারা বৎসর করা হয় না কেন? সম্প্রতি পুর প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান ফিরহাদ হাকিম স্বয়ং নিকাশি ও সেচ দফতরের কাজের গতি লইয়া সমালোচনা করিয়াছেন। নাগরিক তবে যাইবেন কোথায়?
এবং সমস্যা একা কলিকাতার নহে। কলিকাতা বানভাসি হইলে তাহা খবর হয়, দ্রুত ব্যবস্থা করা হয়। অন্যত্র সেই জল জমিয়া থাকে দিনের পর দিন। উত্তর ২৪ পরগনার বারাসত হইতে কলিকাতার পার্শ্ববর্তী হাওড়া, হুগলি— সর্বত্র বর্ষা নামিলেই নিকাশিব্যবস্থার বেহাল চিত্রটি উন্মুক্ত হইয়া পড়ে। ইয়াসের তিন সপ্তাহ পরেও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বহু স্থানে জল জমিয়া ছিল। জমা জলে পেটের অসুখ বৃদ্ধি পায়, দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হইয়া উঠেন বাসিন্দারা, বিদ্যুৎপৃষ্ট হইয়া মৃত্যুর ঘটনা বাড়ে। সর্বোপরি, মশার বংশবিস্তার সহজতর হয়। প্রতি বৎসর বর্ষার আগমনের সঙ্গে কলিকাতা ও সংলগ্ন জেলাগুলিতে যে ভয়ঙ্কর ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, তাহার কারণটি সহজবোধ্য। ইহা জনস্বাস্থ্যের প্রশ্ন, বৎসরের পর বৎসর উপেক্ষিত থাকিতে পারে না। সমস্যার উৎসটি যখন অজানা নহে, তখন অন্যের ঘাড়ে দোষ না চাপাইয়া অবিলম্বে উপযুক্ত ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।