বেচারি পুলিশ। ডাকাত-খুনি সন্ধান করিলেও করিতে পারে, কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় ‘অরাজনৈতিক’ ব্যক্তি খুঁজিতে হিমশিম খাইতেছে। পুলিশি অনুরোধেও কেহ নাকি এলাকার শান্তি কমিটির সদস্য হইতে সম্মত হইতেছেন না। এ দিকে সরকারি নির্দেশ, পুলিশের দ্বারা চিহ্নিত, নবান্ন দ্বারা অনুমোদিত ব্যক্তিদের লইয়া পাড়ায় পাড়ায় গড়িতে হইবে শান্তি কমিটি। এলাকায় সংকট দেখা দিলে তাহাদের সহিত বৈঠক করিবে পুলিশ। ইহাতে কতটা কাজ হইবে, তাহা পরের কথা। আপাতত পুলিশের এই নাজেহাল দশা দেখিয়া হাস্যরসের সহিত করুণ রসও মিশিতেছে। অরণ্য উজাড় করিয়া বহুতল বানাইয়া প্লাস্টিকের গাছ-লতা ঝুলাইলে যেমন হাসি পায়, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দলীয় রাজনীতি ঢুকাইয়া ‘নিরপেক্ষ’ শান্তি কমিটি নির্মাণের চেষ্টাও তদ্রূপ। এক সময়ে শহরের পাড়া বা মহল্লায়, জেলার গ্রামে বা মৌজায় ‘কমিটি’ গঠনের প্রয়োজন হইত না। হাসপাতাল-সঙ্গী হইতে শ্মশানযাত্রী, পূজা-ইদ উপলক্ষে উৎসব হইতে বন্যা বা খরার মতো বিপর্যয়ে ত্রাণ বিতরণ, সকল কাজেই স্বাভাবিক সংগঠক ও কর্মী মিলিত।
এমন নহে যে তাহাদের মধ্যে সংকীর্ণতা, হীনতা ছিল না। অম্বেডকর যে গ্রামের সমাজকে কূপমণ্ডূকতা এবং বর্ণবৈষম্যের বাসা বলিয়াছিলেন, সে অকারণ নহে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পল্লীসমাজ’-সহ নানা উপন্যাসে সমাজের প্রতিনিধিদের যে পরিচয় আমরা পাই, তাহাতে আশ্বাস অপেক্ষা অস্বস্তি অধিক হয়। কিন্তু প্রতিনিধিদের সেই ভাল-মন্দ ছিল গ্রামের পাঁচটি মানুষের ভাল-মন্দের প্রতিফলন। আত্মীয়-প্রতিবেশীর পরিচয়েই তাঁহারা শ্রদ্ধা ও প্রশ্রয় দাবি করিয়াছেন। অপর কাহারও প্রতিনিধি হইয়া গ্রামের মানুষকে উত্ত্যক্ত করেন নাই। কিন্তু দলীয় রাজনীতি সেই ছবি বদলাইয়াছে। বিশেষত দীর্ঘ শাসনের অবকাশে বামপন্থী দলগুলি ক্যাডার দিয়া গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপ হইতে পাড়ার ক্লাব, সবই দখল করিয়াছে। ইহাতে রাজনীতির ভিত্তি পোক্ত হইয়াছে, সমাজবন্ধন আলগা হইয়াছে। কোনও স্থান ‘নির্দলীয়’ হইয়া বাঁচে নাই, কোনও সিদ্ধান্ত ‘অরাজনৈতিক’ হইবার উপায় নাই।
আজ কলিকাতার বহু বড় বড় দুর্গাপূজার আয়োজক কোনও না কোনও মন্ত্রী। ইফতারের ভোজেও রাজনৈতিক দলের দখলদারি। পূর্বে সমাজ সমবেত চেষ্টায় শান্তিরক্ষা হইতে মশক-নিধন, সকল বিষয়েই নিজের প্রয়োজন নিজে মিটাইত। এখন তাহার স্থান জুড়িয়া বসিয়াছে রাজনৈতিক সমাজ, যাহা রাষ্ট্রের সহিত দরদস্তুর করিয়া এলাকার জন্য কিছু আদায় করিতে চাহে। তাহার কর্তা তিনিই, যিনি রাষ্ট্রশক্তির কাছের মানুষ, নেতা-আমলার ঘনিষ্ঠ। পাড়ার মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্যতা এই নূতন নেতাদের পক্ষে আবশ্যক নহে। সুবিধাভোগী এবং সুবিধা-বিতরণকারী মানুষই পাড়ার ‘দাদা’ ‘দিদি’-র স্থান পাইয়াছেন। পাড়ার মানুষের প্রতিনিধিত্ব এখন দলীয় প্রতিনিধিত্বের অপর নাম। এই কারণেই নির্দল ব্যক্তিরা পুলিশ-প্রশাসনের অনুমোদিত কমিটির সদস্য হইবার প্রস্তাবে অসম্মত। তাঁহারা ভালই জানেন, প্রশাসনের সহিত রাজনৈতিক দল, এবং দলের সহিত পুলিশের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। পুলিশ ‘নির্দল’ বলিলে শ্যাম ও কুল, দুই-ই নাশ হইবে। শান্তির জন্য এত অশান্তি কে সহিবে?