ওজ়োন ও উষ্ণায়ন।
সিদ্ধার্থ মজুমদারের ‘পৃথিবীর রক্ষাকবচ, জীবনেরও’ (২০-৯) শীর্ষক প্রবন্ধে কয়েকটি বিষয় সংযোজন করতে চাই। বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করে দেখিয়েছেন, সারা বছরই ওজ়োন স্তর (প্রবন্ধে উল্লিখিত আনুমানিক ১৫-৩৫ কিলোমিটার) একই উচ্চতায় অবস্থান করে না। পৃথিবীর অক্ষাংশ ও ঋতুগত পরিবর্তনের ফলে এই স্তরের উচ্চতাতেও পরিবর্তন ঘটে থাকে। স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারিক ওজ়োন স্তর এমন একটি ছাতা, যা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে পার্থিব প্রাণী ও উদ্ভিদকুলকে রক্ষা করে চলেছে। ১৯৭৬ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা আন্টার্কটিকার ‘হ্যালি বে’ অঞ্চলের বায়ুমণ্ডলে ওজ়োন গ্যাসের পরিমাপ করতে গিয়ে দেখেন, তার ঘনত্ব স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকখানি কম। ১৯৫৭ সাল থেকেই এই অঞ্চলে বাতাস পরিমাপের কাজ চলছিল। দেখা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর— তিন মাসে ওজ়োনের মাত্রা প্রায় ১০ শতাংশ হ্রাস পাচ্ছে। শীতে মেরুবায়ু শীতল হিমকণাযুক্ত মেঘের সৃষ্টি করে। এর উপর সূর্যরশ্মি পড়লে সিএফসি ভেঙে ক্লোরিনকণা তৈরি হয়। আর বসন্তকালে ক্লোরিনকণার উপরে সূর্যকিরণ পড়লে ওজ়োন দ্রুত লয়ে ভেঙে যায়। তৈরি হয় ‘ওজ়োন হোল’, অর্থাৎ ওজোন স্তরের গভীরতা কমে যাওয়া, বা হালকা হয়ে যাওয়া।
এর জন্য প্রধানত দায়ী আমাদের বিলাসবহুল জীবনযাপন। বাতানুকূল যন্ত্র ব্যবহারের অনিবার্য পরিণাম ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (সিএফসি) নিঃসরণে বৃদ্ধি। সিএফসি বিধ্বংসী হারে ভাঙতে লাগল ওজ়োন গ্যাসের ভাসমান কণাগুলোকে। ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মন্ট্রিয়ল প্রোটোকল-এর সনদে দাবি করা হয়, পৃথিবীর ওজ়োন স্তরকে ১৯৮০ সালের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেই মূল সনদের পরিবর্ধন, পরিমার্জন করা হয়েছে জলবায়ু বিষয়ক নানা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। ওজ়োন-অবক্ষয় ও বিশ্ব-উষ্ণায়ন, দুটো সমান্তরাল ভাবে চলে। তাই এক বার ভাবা হল, সিএফসি-র বিকল্প হিসেবে ‘হাইড্রোফ্লুরোকার্বন’ ব্যবহার করে দেখা যাক। দেখা গেল, তাতে কার্বন ডাইঅক্সাইডের চাইতেও বেশি উষ্ণায়ন ঘটে। ফলে পৃথিবী জুড়ে দাবি উঠল, ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থের অনিয়ন্ত্রিত নিঃসরণ অবিলম্বে কমাতে হবে।
আশার কথা, ১৯৮৭ সালে মাত্র ৪৫টি দেশকে নিয়ে মন্ট্রিয়ল ঘোষণাপত্র যে যাত্রা শুরু করে, আজ সেই ঐতিহাসিক চুক্তিতে দায়বদ্ধ দেশের সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১৯৭-তে পৌঁছেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওজ়োন স্তর এখন তাঁদের চূড়ান্ত নজরদারিতে রয়েছে, সামান্য ক্ষতি হলেই দ্রুত মেরামতির নিদান দিচ্ছেন। এ বিষয়ে আমাদেরও সতর্ক থাকতে হবে, কারণ ওজ়োন বাঁচলে জীবন বাঁচবে।
বিশ্বদীপ ভট্টাচার্য, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
সরকারি বাস
দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির সঙ্গে শহরের যোগাযোগের অন্যতম সরকারি গণপরিবহণ হল দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগম। এজেন্সির মাধ্যমে সেই নিগমে নিযুক্ত চুক্তিভিত্তিক বাসচালক ও বাস পরিচালকরা সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করেন পুজোর আগে (‘মন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, আশ্বাসেও বাসে অচলাবস্থা জারি’, ২৭-৯)। দিঘা ডিপোতে তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের নামে শুরু হওয়া ঠিকাচুক্তি কর্মীদের এই আন্দোলন নিগমের তিনটি ডিভিশনের অন্তর্গত কুড়িটি বাস ডিপোর মধ্যে ষোলোটিতে ছড়িয়ে পড়ে। এক সপ্তাহ চলার পরে কর্তৃপক্ষ দীপাবলির পরে আলোচনায় বসার আশ্বাস দিলে ধর্মঘট উঠে যায়, যদিও দাবি থেকে সরেননি কর্মীরা। তবে শুধুমাত্র ঠিকা শ্রমিকদের চাওয়া-পাওয়ার নিরিখে আন্দোলনের বিচার করতে বসলে অন্ধের হস্তীদর্শন হয়।
প্রথমত, সরকার কোনও সুসংহত পরিবহণ নীতি তৈরি করতে ব্যর্থ। সরকারি বাসের ভাড়া না বাড়ানোর প্রশ্নে সরকার অনড়, অথচ বেসরকারি বাস নিয়ম-বহির্ভূত ভাবে ভাড়া বাড়িয়ে নেওয়ার স্বাধীনতা পেয়েছে। শহরতলির রুটে একই দূরত্বে যেখানে বেসরকারি বাস ২৫ টাকা আদায় করে, সেখানে সরকারি বাসের ভাড়া মাত্র ১২ টাকা। অথচ, দু’বছর আগে প্রতি লিটার ডিজ়েলের দাম ছিল ৬২ টাকা, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯২ টাকা। সরকারি বাসের ভাড়া আনুপাতিক হারে না বাড়াতে দেওয়ায় লোকসানের বহর উত্তরোত্তর বেড়েছে, আইওসি ও স্থানীয় রিটেলার পাম্পগুলির কাছে বকেয়ার পরিমাণ ৮ কোটি টাকারও বেশি।
দ্বিতীয়ত, গাড়ির যন্ত্রাংশ ও রক্ষণাবেক্ষণের খাতে প্ল্যান ফান্ডের টাকা বরাদ্দ করছে না সরকার। পুরনো বাসের মেরামতি খরচ বেশি, তাই প্রতি বছর নতুন বাস কিনে ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হয়। এই নিগমে শেষ বাস কেনা হয়েছিল ২০১৯ সালে। নতুন বাস কেনা বন্ধ, এবং পুরনো বাস রক্ষণাবেক্ষণ ও যন্ত্রাংশ কেনার টাকার অসঙ্কুলান। এ যেন মুমূর্ষু রোগীর মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে নেওয়ার শামিল।
তৃতীয়ত, অর্থ দফতরের অনুমতি ছাড়াই এজেন্সির মাধ্যমে ঠিকা শ্রমিক (যাঁদের অধিকাংশ অপ্রয়োজনীয়) নিয়োগ। সংখ্যাটি প্রায় চারশো। নিগমের নিজস্ব আয় থেকে বেতন (মাসে প্রায় ৭০ লক্ষ টাকা) দিতে হচ্ছে। নাভিশ্বাস উঠছে নিগমের।
চতুর্থত, পরিষেবা প্রদানের নামে (পড়ুন রাজনৈতিক চাপে) অলাভজনক রুটে গাড়ি চালানোর বাধ্যবাধকতা, প্রত্যন্ত জায়গায় ডিপো উদ্বোধন করে ওভারহেড খরচ বাড়িয়ে দেওয়া, নামমাত্র মূল্যে সেলিং এজেন্ট, ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি এজেন্টের হাতে লাভজনক রুট তুলে দেওয়া, অফিস অটোমেশন-এর নামে লক্ষ লক্ষ টাকার শ্রাদ্ধ— সব এই পর্যালোচনার মধ্যে আসা উচিত।
পঞ্চমত, নিজস্ব পরিকাঠামো ও মানবসম্পদ থাকা সত্ত্বেও ধর্মতলা, করুণাময়ী, দিঘা, বর্ধমান, দুর্গাপুর-সহ বিভিন্ন প্রান্তে বুকিং এজেন্ট নিয়োগ করছে নিগম। কমিশনের অঙ্ক ফেলনা নয়, যা অনায়াসে সংস্থার আয়ে যোগ হতে পারত।
ষষ্ঠত, অতিমারি পর্বে তথাকথিত ‘কোভিড যোদ্ধা’-দের পুরস্কৃত করার ছলে বোর্ডের মিটিং ডেকে পাইকারি হারে ৬৮ জনকে রাতারাতি প্রোমোশন পাইয়ে দেওয়া হয়। সেই সব ‘যোদ্ধা’দের প্রোমোশন-জনিত ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট’-এর অর্থ জোগানোর দায়িত্ব সরকার নামক গৌরী সেনের।
এজেন্সির মাধ্যমে ঠিকাচুক্তিতে নিযুক্ত চালক/পরিচালকরা যে নিগমের মূল চালিকাশক্তি, চালকদের আন্দোলন চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিল। আগে দৈনিক গড়ে ৪৭০টি বাস পথে নামায় প্রায় ৪৪.৫০ লক্ষ টাকা আয় হত। ধর্মঘটের দিনগুলিতে নিজস্ব ড্রাইভার দিয়ে চালানোয় সেই পরিসংখ্যান হল যথাক্রমে ৭২টি ও ৭.৯০ লক্ষ টাকা। যে কর্মীরা নিগমকে লাভজনক করছেন, তাঁরা কি মানবিক ব্যবহার আশা করতে পারেন না?
দৈনিক ৫১৯ টাকা বেতনে ২৬ দিন বাস চালিয়ে এক জন ঠিকা শ্রমিকের গড় বেতন দাঁড়ায় ১৫০০০ টাকা। সাপ্তাহিক ছুটির দিন ব্যতীত কোনও আপৎকালীন সবেতন ছুটির ব্যবস্থা নেই। ‘নো ওয়ার্ক নো পে’ নিয়মের নিগড়ে তাঁরা বাঁধা। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে বাধ্য। তারই বহিঃপ্রকাশ এই আন্দোলন। বিরোধী রাজনৈতিক চক্রান্তের ভূত দেখতে পাওয়াটা বালিতে মুখ গুঁজে থাকার নামান্তর।
জি রাজশেখর, শিবপুর, হাওড়া
থার্মোকল
পশ্চিমবঙ্গে এ বছর চল্লিশ হাজারেরও বেশি সংগঠন দুর্গাপুজোর জন্য সরকারি অনুদান পেয়েছে। অনুদানের অন্যতম পালনীয় বিধি ছিল, থার্মোকলের ব্যবহার করা চলবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, বহু মণ্ডপেই যথেচ্ছ থার্মোকল ব্যবহৃত হয়েছে। সাবেক শোলার সাজের বদলে এখন প্রতিমা ও মণ্ডপের সজ্জা অনেকেই থার্মোকল দিয়ে করছেন। সেই রকম, পুজোর প্রসাদ, ভোগ খাওয়ার জন্যও থার্মোকলের থালা-বাটি ব্যবহার হয়েছে। থার্মোকল ‘আর্ট-ফ্রেন্ডলি’ হলেও ‘ইকো-ফ্রেন্ডলি’ নয়। তা ভূমি-দূষণের কারণ। পোড়ালে বায়ু দূষিত হয়, ক্যানসার-সৃষ্টিকারী গ্যাস নির্গত হয়। আমরা আর কবে সচেতন হব? প্রশাসনই বা এত উদাসীন কেন? অনুদানের শর্ত লঙ্ঘন কেন নজরে আসে না?
প্রদীপ রঞ্জন রীত, আমতা, হাওড়া