জনবিস্ফোরণ বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ ‘কাকে স্বাধীনতা বলে, বুঝিনি’ (১৫-৮) সম্পর্কে আমার কিছু মতামত জানাতে চাই। স্বাধীনতার এই ৭৫ পূর্তির বছরে এসেও তিনি স্বাধীনতার বিষয়ে বুঝতে না পারার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ভারতের জনসংখ্যা এবং জনবিস্ফোরণ সম্পর্কে চিন্তাশীল মানুষের অনীহা বা অবহেলা।
আমরা জানি, জনসংখ্যা একটা মানবসম্পদ, যদি তাকে যথাযথ ভাবে কাজে লাগানো যায়। অন্যথায় কিন্তু এটা ভার বা বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পার করেও আমরা সেই উপলব্ধি যে মাঝে মাঝে বিস্মৃত হয়ে যাই— এটাই ভাবতে অবাক লাগে। এক জন সমাজ সচেতন এবং চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে লেখক আমাদের এই বিষয়টি নিয়ে আবারও সচেতন করে দিতে চেয়েছেন।
জনবিস্ফোরণ কমানোর ক্ষেত্রে কয়েকটি পদক্ষেপ করা যায়। প্রথমত, নিঃসন্তান দম্পতিকে আর্থিক পুরস্কারের মাধ্যমে উৎসাহ প্রদান করা যায়। দ্বিতীয়ত, একমাত্র সন্তানের পিতা-মাতাকেও পুরস্কার প্রদান করার কথা ভাবা হোক। তৃতীয়ত, তিন বা ততোধিক সন্তানের পিতা-মাতাকে আর্থিক জরিমানা করার কথা ভাবা যেতে পারে। চতুর্থত, জন্মনিরোধক বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আরও জোরদার প্রচার হওয়া প্রয়োজন। পঞ্চমত, বন্ধ্যাত্বকরণকে বিভিন্ন রকম ভাবে উৎসাহিত করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
প্রসঙ্গত, উল্লিখিত পদ্ধতিগুলো কার্যকর করার ক্ষেত্রে নানা সামাজিক এবং ধর্মীয় বিশ্বাস ও কুসংস্কার যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবে সেগুলিকে কী ভাবে রোধ করা যায়, তার জন্য প্রয়োজনে সমাজবিজ্ঞানীদের পরামর্শ ও সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। সম্প্রতি একটি তথ্যে জানা গিয়েছে যে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই জনসংখ্যার দিক থেকে চিনকে পিছনে ফেলে ভারত হয়ে উঠবে বিশ্বের প্রথম স্থানাধিকারী। এই তথ্য মোটেই গৌরবের কিছু নয়। এ-হেন অবস্থাকে এড়াতে হলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। আমাদের দেশে জনসংখ্যা কেবলমাত্র বিভিন্ন রাজনৈতিকদলের ভোটবাক্স ভর্তি করার ক্ষেত্রে যত না ব্যবহৃত হচ্ছে, সামাজিক এবং আর্থিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে ততটা নিশ্চয়ই নয়।
বাঁধন চক্রবর্তী, কৃষ্ণনগর, আগরতলা
‘আমি’কেন্দ্রিক
অগস্ট মাসটি ভারতীয়দের জন্য একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস। ১৯৪৭ সালের ১৪ তারিখ মধ্যরাতে, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ঘোষণা করেছিলেন— মধ্যরাত্রিতে, যখন গোটা দুনিয়া ঘুমে আচ্ছন্ন, ভারত তখন জীবন ও স্বাধীনতার স্পর্শে জেগে উঠবে।
ইতিহাসে এই ধরনের মুহূর্ত হয়তো কমই আসে, কিন্তু আসে। যখন পুরাতন থেকে নতুন এক অধ্যায়ের দিকে যাত্রা শুরু হয়। সেই স্বাধীন ভারতের ৭৫ বছরের পূর্তি উৎসব পালন করা হল এই বছর। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এই উৎসবের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’। নিদান দেওয়া হয়েছিল, প্রতি ঘরে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে, তার ছবি সমাজমাধ্যমে দিতে হবে, যার আনুষ্ঠানিক নাম দেওয়া হয়েছিল ‘হর ঘর তিরঙ্গা’। অনেকে অবশ্য প্রশ্ন তুলেছিলেন, যাঁদের ঘর নেই, বা যাঁদের ঘর বুলডোজ়ার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁরা কী ভাবে পতাকা তুলবেন? কিন্তু এই সব তো রাজনৈতিক কচকচানি। প্রতি ঘরে তিরঙ্গা তোলার বার্তার মধ্যে কি কোনও সামাজিক সমীকরণের বিষয়ও আছে?
সুশীলা মিত্র, বছর পঞ্চাশ বয়স, ঘটকপুকুরের একটি স্কুলের শিক্ষিকা। বেশ কিছু দিন তিনি এই স্কুলে কর্মরতা, স্বামী রেলের কর্মী। তিনি বলছিলেন, আজ অবধি কোনও দিনও দেখেননি কেন্দ্রীয় সরকারের এই রকম তৎপরতা। রেল কর্তৃপক্ষ গত জুলাই মাসের বেতন থেকে পঞ্চাশ টাকা কেটে নিয়ে, ভারতের জাতীয় পতাকার একটি সংস্করণ হাতে তুলে দিয়ে নির্দেশ দিয়েছে— পরিবারের সঙ্গে ওই পতাকা তুলে একটি ছবি একটি নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে আপলোড করতে হবে। না করলে কী হবে, তা অবশ্য বলা হয়নি রেল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। সুশীলা মিত্র তাই স্বাধীনতা দিবসের দিন বাড়িতে পতাকা তুলে একটু দেরিতেই ঢুকেছেন স্কুলের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। যখন দেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূরণ হয়েছিল, তখন এই রকম কোনও নির্দেশ তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এসেছিল কি না, সুশীলাদির মনে পড়ে না। কিন্তু এই বারের নির্দেশের মধ্যে যে অন্য কিছু আছে, তা বেশ বুঝতে পারছেন। তাঁর একটা কথা মনে হয়েছে, এই হর ঘর তিরঙ্গা, মানুষকে আরও একা করে দেওয়ার চক্রান্ত নয়তো?
সুশীলাদি বলছিলেন তাঁর ছোটবেলার কথা, যখন তিনি স্কুলে পড়তেন। তখন স্বাধীনতা দিবস পালিত হত সমষ্টিগত ভাবে। তাঁরা স্কুলে যেতেন, বড় দিদিমণি পতাকা তুলতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, তাতে গান্ধী, নেহরু, ভগৎ সিংহ, সুভাষ বসুদের অবদান সম্পর্কে কিছু বলতেন, তার পর জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হত। জাতীয় সঙ্গীত শেষ হলে সমস্ত ছাত্রছাত্রীর জন্য একটা ছোট কেক বা মিষ্টি দেওয়ার পর সবাই বাড়ি ফিরতেন। পাড়ার ক্লাবগুলোতেও এই ধরনের অনুষ্ঠান হত। অঞ্চলের এক জন বয়স্ক ব্যক্তি, যিনি স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে কিছু কথা বলতে পারবেন, তাঁকে অনুষ্ঠানে ডাকা হত। তাঁর হাতেই জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হত। সেই সময় এই ধরনের অনুষ্ঠানে একটা সমষ্টিগত আনন্দ পাওয়া যেত। এই ভাবেই ধীরে ধীরে সবাই বড় হয়ে উঠতেন, ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে মিশে যাওয়ার শিক্ষা পেতেন। কিন্তু এই বারের পঁচাত্তর বছর পূর্তিতে এসে ধারণাগুলোই কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।
তা হলে আজকের এই সমাজমাধ্যম, যা নিয়ে আমরা সারা ক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকি, তাতে নিজের ঘরে জাতীয় পতাকার তোলা ছবি আপলোড করা, কত জন পছন্দ করলেন, কে কী মন্তব্য করলেন, তা কি আসলে আবারও সেই সমষ্টির চেতনা থেকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে দেওয়ার চক্রান্ত? সুশীলাদির সহকর্মীরা কেউ কেউ তাঁর কথার বিরোধিতা করলেন। তাঁরা বললেন, জাতীয় পতাকা শুধু তো কেন্দ্রীয় শাসক দলের সম্পত্তি হতে পারে না, এই পতাকায় সবার অধিকার। এক জন বললেন, যখন এনআরসি বিরোধী আন্দোলন হচ্ছিল, তখন তো জাতীয় পতাকাকে কেন্দ্রের শাসক দলের হাত থেকে কেড়ে নেওয়ারই লড়াই ছিল। আজকে যদি সেটা প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছয়, তাতে ক্ষতি কী? এটা তো ওঁদের হাত থেকে সমস্ত মানুষের কাছে জাতীয় পতাকা পৌঁছে যাওয়া হল, এতে দোষের কী? কিন্তু সুশীলাদির মনটা খচখচ করে যাচ্ছে, সব প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছেন না তিনি।
নোটবন্দির সময়েও এই কেন্দ্রীয় সরকার সমষ্টির চেতনা ভেঙে দিয়েছিল। সবাই ব্যক্তিগত ভাবে ব্যাঙ্ক এবং এটিএমের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন, কেউ সমষ্টিগত ভাবে ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেননি। যখনই বলা হয়েছে আধারের সঙ্গে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, গ্যাসের সংযোগ বা রেশন কার্ডের সংযোগ করাতে হবে, প্রতিটি মানুষ ব্যক্তিগত ভাবে নিজের সমস্যা সমাধানে ছুটেছেন, কেউই সমষ্টিগত ভাবে এই নির্দেশগুলোর বিরোধিতা করেননি। কোভিডের সময়ে যতই প্রচার করা হোক না কেন, রোগীকে নয় রোগকে দূরে রাখুন, বাস্তবে মানুষ কিন্তু ভয় হোক বা ভীতিতে, পাশের বাড়ির শুধু নয়, পাশের মানুষটিকেও দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের আপনজনকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলেন, কোভিডের যাঁরা চিকিৎসা করছেন, সেই মানুষদের ঘর ভাড়া দিতে দ্বিধাবোধ করেছেন।
সমষ্টির চেতনা কখন যে শুধুমাত্র ব্যক্তিচেতনার দিকে হাঁটতে শুরু করেছে, তা আজ কেমন যেন গোলমাল হয়ে গিয়েছে। দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুই হয় ‘আমরা’ শব্দটি দিয়ে… ‘আমরা ভারতের জনগণ’। তা হলে কি ‘আমরা’ শব্দটি আর থাকবে না, সবই ‘আমি’কেন্দ্রিক হয়ে যাবে? ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’-এ কি এটাই আমাদের প্রাপ্তি?
সুমন সেনগুপ্ত, কলকাতা-৭৫