দেবাশিস ভট্টাচার্যের ‘পদের সম্মান বজায় থাকছে?’ (১০-২) শীর্ষক যুক্তিনির্ভর প্রবন্ধটি অত্যন্ত সময়োপযোগী। প্রাবন্ধিক বলেছেন, যুক্তফ্রন্ট আমলে প্রথম রাজ্যের সঙ্গে রাজ্যপালের বিরোধের বড় ঘটনা ঘটেছিল রাজ্যপাল ধর্মবীরের সঙ্গে জ্যোতি বসুদের। সরকার ভেঙে দেওয়ার ‘চক্রী’ ধর্মবীরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জেরে অচিরেই তাঁকে রাজ্য ছাড়তে হয়। এর প্রেক্ষিতে বলি, ১৯৫৯ সালে কেরলের নাম্বুদিরিপাদের সরকারকে ফেলে দেওয়া থেকে শুরু করে আজ ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে দেখা যাচ্ছে যে, কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই দলের সরকার না হলে প্রায়ই রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্যের বিরোধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। এক সময়ে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, সুপ্রিম কোর্টকেও রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সোমাপ্পা রায়াপ্পা বোম্মাই বনাম ভারত সরকারের মামলার পর, সুপ্রিম কোর্টের ৯ সদস্যের বেঞ্চ কিছু শর্ত বেঁধে দেয়, কখন নির্বাচিত সরকার বাতিল করতে সংবিধানের ৩৫৬ ধারা ব্যবহার হবে, কখন হবে না।
উল্লেখ্য, সংবিধান রচনাকালে সংবিধান সভায় বিতর্ক চলাকালীন বাবাসাহেব আম্বেডকর বলেছিলেন যে, রাজ্যপালের ‘ডিসক্রিশনারি পাওয়ার’ বা বিশেষ ক্ষমতা কখনও মন্ত্রিসভার কাজে হস্তক্ষেপে বা বাধা দানের জন্য ব্যবহৃত হবে না। তিনি যা ভেবেছিলেন, তেমনটা কিন্তু ঘটছে না। সাম্প্রতিকতম উদাহরণ, গত আড়াই বছরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে বর্তমান রাজ্যপাল ধনখড়ের বিরোধ। হাওড়া পুরসভা থেকে বালিকে আলাদা করার বিলটি বাস্তবে এখন কোথায়, সেটাও ধোঁয়াশা! জানি না, আগামী দিনে সিবিআই-এর হাতে তদন্তভার তুলে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে কি না! এক পক্ষের দাবি, সই হয়ে সরকারের কাছে ফেরত আসেনি বিল; অন্য পক্ষ বলছে, টেবিলে পড়ে নেই কোনও বিল। ফলে পুরনির্বাচন স্থগিত, হাওড়াবাসীর দুর্ভোগ বেড়েছে।
১৯৩৫ সালের ভারতশাসন আইনের থেকে ধার করে সংবিধানে প্রায় একই রকম ধারায় রাজ্যপাল নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তা যে কার্যত বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা ভুক্তভোগী রাজ্যগুলি ভালই টের পাচ্ছে। এই ব্যবস্থায় অনেক সময়েই মুখ্যমন্ত্রীর তুলনায় রাজ্যপালকে অধিক প্রাধান্য দানের ঝোঁক দেখা যায়। রাজ্যপাল নিয়োগ সংক্রান্ত চূড়ান্ত বিতর্কের শেষে আম্বেডকরই বলেছিলেন, রাজ্যপালের কাজ হবে প্রধানত দুটো— সরকারের সাংবিধানিক অভিভাবক হিসাবে থাকা, এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সরকারকে পরামর্শ দেওয়া। রাজ্যপালরা কাজ করবেন নিরপেক্ষ ভাবে, রাজ্যবাসীর প্রতিনিধি হিসাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ সময়েই রাজ্যপাল রাজ্য সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছেন। এ রাজ্যে বাম আমল থেকেই সেই ঐতিহ্য বহমান।
শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া
একচোখা নীতি
দেবাশিস ভট্টাচার্যের প্রবন্ধের প্রেক্ষিতে বলতে চাই, ভারতের সংবিধান প্রণেতাগণ কোন মানসিকতা থেকে রাজ্যপাল পদটি দেখেছিলেন, তা বুঝতে হবে। দিল্লির মসনদে থাকা ব্যক্তিদের নির্দেশে স্রেফ কলের পুতুলের মতো কাজ করতে থাকবেন রাজ্যপাল, এ কথা তাঁরা কখনওই ভাবেননি। কিন্তু স্বাধীনতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাজ্যপাল পদটির মধ্য দিয়ে কংগ্রেস সরকার বিরোধী দলকে ‘সবক’ শেখানো শুরু করে, কেরলের কমিউনিস্ট পার্টির শাসন উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে। তার পর তো বিভিন্ন বিরোধী রাজ্যে একে একে বদলার পর বদলা— ধর্মবীর, এ পি শর্মা, বি ডি পান্ডে। এই ধারায় বিজেপি জমানায় এই বাংলায় এখন ধনখড়জি রাজ্যপাল। যদি সত্যিই দিল্লির পাঠানো ব্যক্তিই রাজ্যের প্রকৃত শাসক হতেন, তবে কি আর রাজ্যে রাজ্যে এত অর্থ, সময়, নিরাপত্তার মাধ্যমে বিধানসভা-সহ বিভিন্ন নির্বাচনের প্রয়োজন হয়? তাই ধনখড়জি দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে কথায় কথায় টুইটে রাজনৈতিক মন্তব্য করছেন। উন্নাসিকতায় মত্ত হয়ে এমন ভাবে আইনের বক্তব্য রেখে চলেছেন মিডিয়ায়, যাতে সংবিধান প্রণেতাগণেরই অসম্মান হচ্ছে বলে মনে হয়। তবে দোষটা সম্পূর্ণ ওঁর নয়। কংগ্রেসের শেখানো পথেই বিজেপি চলা শুরু করেছে। সেখানে আবার নতুন করে সারকারিয়া কমিশনের জন্ম দিতে হবে বলে মনে হয়। তাতে যে বর্তমানে কংগ্রেস-সহ একাধিক বিরোধী রাজি নয়, তা স্পষ্ট করে মুখে না বললেও বেশ কিছু বিরোধীর আচরণে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। তাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীকে একাধিক বার জানানো সত্ত্বেও যে ভাবে নরেন্দ্র মোদী নীরব থেকে জল মেপে তৃপ্তি পাচ্ছেন, তা যে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা, এ কথা বুঝতে বিলম্ব হয় না। রাজ্যপাল, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, নাগরিক সমাজের বেশ কিছু প্রতিনিধি, মিডিয়ার একাংশ, অনেক বিরোধী দলের নীরবতা যেন এক গভীর চক্রান্ত। ২১৭ জন বিধায়ক সত্ত্বেও যেন বাংলার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টা। এর নাম যদি হয় সুশাসনের মহড়া, তা হলে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার রাখার আর দরকার আছে? কেন্দ্রীয় সরকারের একচোখা নীতিই বাংলার রাজ্যপালকে এই অসুস্থ পথে চলার প্রেরণা দিচ্ছে বলে মনে হয়।
মৃত্যুঞ্জয় বসু, কলকাতা-৩০
দলবদলে রাশ
সম্প্রতি কলকাতা হাই কোর্ট একটি মামলায় উল্লেখ করেছে যে, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা কে কোন দলের সঙ্গে যুক্ত আছেন, সেটা সব সময় বোঝা সম্ভব নয়। আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের মতো নেতাও নতুন দল করেছিলেন। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে আদর্শের বদলে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার তাগিদে দলবদল হচ্ছে যেন জামা বদলের মতো। এতে সমস্যা হয়েছে সাধারণ মানুষের। কোন নেতা কোন দলের, সেটা বোঝার কোনও উপায় নেই। শুধু তা-ই নয়, ভোটের আগে নেতারা এক দলের, আর ভোটের পর তিনি আর এক দলের, এটা বিরল ঘটনা নয়। এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতারা কে কোন দলভুক্ত, সেটা নির্বাচন কমিশন থেকে সচিত্র পরিচয়পত্র দিয়ে ভোটারদের জানানো হোক। অর্থাৎ, এক জন নাগরিকের সক্রিয় রাজনীতি করার একটা বৈধ পদ্ধতি তৈরি করা হোক। দল পরিবর্তন করতে হলে নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করে একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুযায়ী করতে হবে। প্রথমে একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য পদ নিতে হবে এবং সেই সদস্য পদের নথি-সহ নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন সিলমোহর দিলে তবেই সেই ব্যক্তি নির্বাচন প্রক্রিয়া বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার স্বীকৃতি পাবেন। রাজনৈতিক পরিচয়পত্র চালু হলে দেশ জুড়ে ঘোড়া কেনাবেচায় কিছুটা লাগাম পরানো সম্ভব হবে।
সৌগত মাইতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
বিজয় কই?
গত বছর আমাদের স্কুলের প্রাণচঞ্চল এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “মাধ্যমিকে লেটার পাওয়া সত্ত্বেও তোমাকে বিমর্ষ লাগছে কেন?” সে বলেছিল, “পরীক্ষা দিয়ে যদি সেকেন্ড ডিভিশনও পেতাম, তা হলেও আনন্দ পেতাম, বন্ধুদের মিষ্টি খাওয়াতাম।” বহু ছাত্রছাত্রীর মুখে এ ধরনের কথা শুনেছি। আজ দেখছি, পুরভোটে বুথ জ্যাম, রিগিং করে জয়লাভ করেও বিজয় মিছিলে হাঁটছেন নেতারা। এ যেন অনেকটা নকল করে পরীক্ষায় পাশ করা। যুদ্ধ না করে জিতে যাওয়ার মধ্যে কি সত্যিই আনন্দ থাকে? যুদ্ধ না করে কী ভাবে বিজয় হয়, আর বিজয় না হলে কী ভাবে বিজয় মিছিল হয়, বুঝতে পারি না।
নিখিল কবিরাজ, রামনগর, হাওড়া