কথায় আছে, কত ধানে কত চাল! কিন্তু বীজতলা থেকে শুরু করে বাজারের থলেতে এক কেজি চাল হেঁশেল পর্যন্ত আসতে কত জল লাগে? প্রায় ২৫০০ লিটার! ঠিক সে ভাবেই এক কেজি আলুতে ৫০০ লিটার, এক কাপ কফিতে ১৪০ লিটার ও একটা আপেলের জন্য প্রায় ৭০ লিটার জল লাগে। এ তো গেল উদ্ভিজ্জ খাবারের হিসেব। কিন্তু প্রাণিজ খাবার উৎপাদনে আরও বেশি জল লাগে। এক কেজি খাসির মাংসে ১৫৪০০ লিটার, এক কেজি মুরগির মাংসে ৩৭০০ লিটার, একটা ডিমে ২০০ লিটার, এক গ্লাস দুধে ২৫০ লিটার জল লাগে। আর যে খাবারটা আমাদের বাচ্চারা মুড়িমুড়কি ফেলে মুড়িমুড়কির মতো খায়, সেই চকলেটের ১০০ গ্রাম উৎপাদনে লাগে ১৭০০ লিটার জল। জলের অভাবে বিঘ্নিত হবে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা। খাবার ছাড়াও বাঁচতে গেলে পোশাক, যাতায়াতও জরুরি। একজোড়া জিনসের পোশাকে জল লাগে ৮০০০ লিটার। একটি মোটরগাড়ি তৈরি করতে লাগে ১৪৭৯৭১ লিটার জল।
ভূগর্ভস্থ জলের সঙ্কটের আরও কারণ আছে। ভারত জল রফতানির ক্ষেত্রে বিশ্বে তিন নম্বরে থাকা দেশ। রফতানি করে পৃথিবীর মোট রফতানি হওয়া জলের ১২ শতাংশ। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ৭৪২৬টি লাইসেন্স পেয়েছে জল বোতলবন্দি করে এমন কারখানা। আর লাইসেন্স ছাড়া কত আছে কে জানে? জলদূষণের কারণে আমরা অনেকেই বোতলবন্দি জলের উপর নির্ভরশীল। সাড়ে সাত কোটি ভারতীয় এখন জল কিনে খান। যাঁরা বোতলবন্দি জল বিক্রি করেন তাঁরা খোঁজ নেন না ব্লকটা সঙ্কটজনক কি না। কতটা জল তোলা যাবে? কারখানার পাশে যাঁদের বাড়ি, এক দিন তাঁরা দেখেন, তাঁদের কলে আর জল উঠছে না। করুণ মুখে দেখেন, রাস্তা দিয়ে ভ্যানে করে চলেছে জলের জার। কিনতে পারলে তবেই মিটবে তেষ্টা। না মেটাতে পারলে প্রতি বছর পানীয় জলের সমস্যায় মৃত দু’লক্ষ মানুষের সংখ্যাটা আরও বাড়বে।
কৃষিতে ছাড়াও গৃহস্থালির কাজেও প্রচুর জল নষ্ট হয়। দাঁত মাজার পুরোটা সময় ট্যাপ খুলে রাখলে চার গ্যালন জল নষ্ট হয়। শেভিং করার সময়ও তাই। স্নানের সময় শাওয়ার পাঁচ মিনিট বেশি চালালে প্রতি মিনিটে ৫-১০ গ্যালন জল নষ্ট হয়। কল খুলে রেখে বাসন মাজলে প্রতিদিন ২০-৬০লিটার জল নষ্ট হয়। সবথেকে বেশি জল নষ্ট হয় কলের মুখ, শাওয়ার, টয়লেটের সিস্টার্নে লিকেজ থাকার জন্য। সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়তে থাকে। এক মিনিটে ১০ ফোঁটা জল পড়লে বছরে প্রায় ৫২৬ গ্যালন জল নষ্ট হয়। প্রতিদিন বহু ট্যাঙ্ক ওভার ফ্লো হওয়ার কারণে আর রাস্তার কল খোলা থাকায় প্রচুর জল নষ্ট হচ্ছে। বাড়িতেও খেতে বসলে গ্লাস ভরে জল নিই। তার পরে প্রায়ই কিছুটা জল ফেলে দিই। বর্তমানে আর.ও. পদ্ধতির ফিল্টার খুব প্রচলিত। এতে শুদ্ধ জল তৈরিতে ২০ শতাংশ জল নষ্ট হয়। একটি পরিবারে যদি দিনে ২৪ লিটার জল লাগে তা হলে দিনে নষ্ট হয় ৪.৮ লিটার জল। বছরে ১৭৫২ লিটার জল!
ভূগর্ভস্থ জলের ভাণ্ডার নিঃশেষ হতে চলেছে। এই ভাণ্ডারকে পুনরায় পুষ্ট করতে পারে মাটিতে শোষিত হওয়া বৃষ্টির জল। ফাঁকা জায়গা, মাঠ, জলাশয় হল বৃষ্টির জলের নীচে নামার পথ যা আজ কমতে কমতে নেই হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির জল ধরে রাখা বা তাকে মাটির নীচে চালিত করাই এখন সবথেকে জরুরি কাজ। সেই কাজের জন্য প্রয়োজন পরিকল্পনা ও সামান্য হলেও অর্থ। সরকারি স্তরেই এ কাজ হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের চারপাশে প্রতিদিন হারিয়ে যাওয়া পুকুর, জলাভূমি অন্য কথা বলে। আমরা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, গৃহবধূ, ছাত্র-ছাত্রী, বেকার যুবক-যুবতী যাঁদের এই কাজটা এখনই করার সুযোগ নেই তারা কি চুপচাপ বসেই থাকব? একেবারেই না। আমরা যদি ছোট ছোট কিছু অভ্যাস গড়ে তুলতে পারি তা হলে মাটির জলের ভাঁড়ার শূন্য হওয়ার প্রক্রিয়াটার গতি কমিয়ে দিতে পারব। যেমন করে কেপ টাউনের বাসিন্দারা জলের খরচ, অপচয় কমিয়ে ডে-জিরোকে ২০১৭ সাল থেকে পিছিয়ে এনেছে ২০১৯ সালে। আসুন এক বার দেখে নিই, আমরা কাল সকাল থেকেই কী কী কাজ শুরু করতে পারি—
ক) দাঁত মাজার প্রয়োজনীয় সময়টুকুই শুধু কল খোলা রাখা। শেভিং করার সময় রেজার সরাসরি কলে না ধুয়ে বাটিতে জল নিয়ে ধোয়া।
খ) শাওয়ার রোজ দু’-চার মিনিট কম চালানো। সাবান ও শ্যাম্পু মাখার সময় শাওয়ার বন্ধ রাখা।
গ) বাসন মাজা, আনাজ ধোয়ার সময় খোলা কলের ধারায় না ধুয়ে গামলায় জল ভরে ধোয়া। দু’বার ধোয়ার পরে মোটামুটি পরিষ্কার জলটা রান্নাঘর ধোয়ামোছার কাজে ব্যবহার করা।
ঘ) আর.ও. ফিল্টারের টপ টপ করে পড়ে যাওয়া জল পাত্রে ধরে রেখে তা ঘর মোছা, গাড়ি ধোয়া, টয়লেটে ঢালার কাজে লাগানো। টয়লেটে একবার ফ্ল্যাশ কম করলে ৬.৫ গ্যালন জল বাঁচে।
ঙ) খারাপ পাইপ লাইন, কল দ্রুত সারিয়ে ফেলা।
চ) জলের ট্যাঙ্ক ওভার-ফ্লো হওয়া বন্ধ করা।
ছ) নিমন্ত্রণ বাড়িতে বোতলবন্দি জলই গ্লাসে ঢেলে সার্ভ করা। বাড়িতে আধ গ্লাস জল নিয়ে খেতে বসা এবং প্রয়োজনে আবার নেওয়া।
নীতি আয়োগ নিদান শুনিয়েছে ভারতের একুশটি বড় শহরকে। তাদের হিসাবে উঠে না আসা অজস্র ছোট জনবহুল শহরের কী অবস্থা আমরা জানি না। জানি না কোথায় এখন দাঁড়িয়ে বহরমপুর বা এ জেলার অন্য এলাকাগুলো। ২০১১ সালে বহরমপুর ছিল আধা সঙ্কটজনক। তার পরে বেড়েছে মানুষ, বেড়েছে ছ’তলা ফ্ল্যাটের সংখ্যা, কমেছে জলাশয় ও খোলা জায়গার পরিমাণ। তবে কি ডে জিরো এগিয়ে এল আমাদের শহরের! কিন্তু এখনও আমরা তাকে পিছিয়ে দিতে পারি। বহরমপুর শহরে থাকেন তিন লক্ষ মানুষ। গোটা জেলায় সংখ্যাটা ৭১ লক্ষ। আমরা সবাই যদি একটুও জল অপচয় না হতে দিই এবং চেষ্টা চালিয়ে যাই জলাশয় বাঁচানোর, বৃষ্টির জল সংরক্ষণের, তা হলে আমার বিশ্বাস আমরা পারব। শুধু আমাদের মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে জল অপরিহার্য সম্পদ আর তা থেকেই আসে বেচেঁ থাকার যাবতীয় রসদ। জল বাঁচাতেই হবে। তা হলে বহরমপুর বা মুর্শিদাবাদের কোথাও ‘ডে-জিরো’ আসবে না কোনওদিন।
প্রধান শিক্ষিকা, বহরমপুর লিপিকা মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল
তথ্যসূত্র: 1. Ground water year book - 2015-16, CGWB.
2. Overview of ground water in India. Roopal Suhag.
3. Status of water resources in W.B. ,Kalyan Rudra.
4. Environment Assessment Final Report.
5.NDTV.
6.UNESCO: Drops of water.