ইরান-আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্ক ও ভারতবর্ষ

এই সময় ইরানের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারির পরে ভারত ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ রেখেছে। কিন্তু ভারত-ইরান কূটনৈতিক সম্পর্কের ৭০ বছর পূর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে দু’দেশই। সেটা আজকের পরিস্থিতিতে খুবই আশাব্যঞ্জক। ভৌগলিক দিক থেকে উপসাগরীয় অঞ্চলে ইরানের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Advertisement

চন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share:

কাসেম সোলেমানি হত্যার প্রতিবাদ ইরানে। ছবি: আইস্টক

গত ৩ জানুয়ারি আমেরিকার ড্রোন হামলায় ইরানের মেজর জেনারেল কাসেম সোলেমানি নিহত হওয়ার ঘটনায় উপসাগরীয় অঞ্চলে ভয়াবহ অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এর জেরে বিশ্ব রাজনীতি এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে টালমাটাল অবস্থা দেখা দিয়েছে। গোটা বিশ্বের শেয়ার বাজারে পতনে এক দিনে লগ্নিকারীদের কয়েক লক্ষ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে। আমেরিকার হস্তক্ষেপে আপাতভাবে এই পতন রোধ করা গেলেও উপসাগরীয় অঞ্চলে এই অস্থিরতা সহজে মেটার নয় বলে মনে করছেন কূটনীতিবিদেরা। এর জবাবে ইরান ইরাকে অবস্থিত দুটি মার্কিন সেনা ছাউনি লক্ষ্য করে ব্যালিস্টিক মিশাইল ছোড়ে। তবে ট্রাম্প প্রশাসন কোনও সৈন্যের মৃত্যুর কথা স্বীকার করেনি। এর ফলে দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তবে আশার কথা, বর্তমানে আমেরিকা ও ইরান দুই দেশই সেখান থেকে পিছিয়ে আসছে। ভারতীয় অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল।

Advertisement

১৯৭৯ সালে ইরানে ‘আয়াতুল্লাহ আন্দোলন’-এর মাধ্যমে এক ইসলামিক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তার আগে সেখানে শাহ শাসন ব্যবস্থা আমেরিকা ও পশ্চিম দেশগুলোর অঙ্গুলিহেলনে পরিচালিত হত। আয়াতুল্লাহ একটা সংগঠন করেছিলেন যাদের মূল কর্মসূচিই ছিল পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের মোকাবিলা করে ইরান এবং তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ইসলামীয়, বিশেষ ভাবে শিয়াপন্থী চিন্তাধারা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো। আয়াতুল্লাহ শাসনের সূচনা থেকেই বিশ্ব রাজনীতিতে ইরানকে অনেক সংঘর্ষ করতে হয়েছে। পাশ্চাত্যের অভিযোগ, লেবাননে হিজবুল্লা, গাজায় হামাস এবং ইরাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের পিছনে ইরানের প্রত্যক্ষ মদত রয়েছে। এ ছাড়াও ইরান ‘পরমাণু শক্তিধর দেশ’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন এবং উন্নত দেশগুলি ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে নানা ভাবে। মাঝেমধ্যেই ইরানের উপরে জারি করা হয়েছে নানা ধরনের আর্থিক নিষেধাজ্ঞা। এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করলে একটি দেশের আন্তর্জাতিক ব্যবসা ও অর্থনীতি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

ভৌগলিক দিক থেকে উপসাগরীয় অঞ্চলে ইরানের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হরমাজ প্রণালী ওমানের গালফ এবং পারস্য গালফের মাঝে সংযোগ স্থাপন করে আরব সাগরে যাওয়ার রাস্তা করে দেয়। সেই পথ দিয়েই গোটা বিশ্বে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করা হয়। ২০১৮ সালে এই প্রণালীর মাধ্যমে গড়ে ফি-দিন ২১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল বিশ্ববাজারে এসেছে। এর বেশির ভাগটারই ক্রেতা আমাদের এশীয় দেশগুলি। এই হরমাজ প্রণালীর উত্তর উপকূলে রয়েছে ইরান। স্বাভাবিকভাবেই এই প্রণালীর উপরে ইরানের যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ফলে ইরানের হস্তক্ষেপে এই তেল বাণিজ্য বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে।

Advertisement

অন্য এশীয় দেশগুলির মতোই ভারত এই প্রণালী থেকে রফতানি করা তেলের উপর বেশ নির্ভরশীল। বর্তমান সময়ে ভারতের পরিবহণ ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তিই হল পেট্রোলিয়াম। অপ্রচলিত শক্তির উপযুক্ত ব্যবহারের পরিকাঠামো তৈরির অভাবে প্রচলিত শক্তির উপরেই আমরা নির্ভরশীল। আমাদের দেশে তেলের উৎপাদন খুব বেশি হয় না। ফলে প্রায় ৮০ শতাংশের মতো তেল আমাদের আমদানি করতে হয়। গোটা বিশ্বের হিসাবে ভারত তেল আমদানিতে তৃতীয় (৭%)। ভারত ইরাক থেকে সবচেয়ে বেশি তেল কেনে। তারপরই রয়েছে সৌদি আরব, ইরান এবং সংযুক্ত আরব আমীরশাহী। পরিসংখ্যান বলছে বর্তমানে ভারতে তেল বিক্রি করার প্রেক্ষিতে সৌদি আরবকে পিছনে ফেলে ইরান দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে।

২০১৮-১৯ সালে ভারতে ২০৭.৩ মেট্রিক টন তেল আমদানি করা হয়েছিল। ২০১৭-১৮ সালে এর পরিমাণ ছিল ২২০.৪ মেট্রিক টন। ২০১৭-১৮ সালে তেল আমদানির বিল মেটাতে লেগেছিল ৬১.৮ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ২০১৮-১৯ সালে লেগেছিল ৮৬.৯ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ৪১ শতাংশ বেশি। বর্তমানে ব্যারেল প্রতি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় কম তেল কিনেও বেশি দাম দিতে হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্য পেট্রোলিয়াম রফতানিকারক দেশগুলি OPEC (Organization of the Petroleum Exporting Countries) নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। এই সংগঠনই বিশ্বের বাজারে তেলের দাম কী হবে তা নির্ধারণ করে। এই সংগঠনে ইরাক, সৌদি আরবের পাশাপাশি ইরানেরও যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। ফলে এই দেশটির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার উপরেও ভারতের তেল অর্থনীতির স্থিরতা নির্ভর করছে।

১৯৯১ পরবর্তী সময়ে ভারতের অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করার পথ প্রশস্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে তার সুফল ভারত পেয়েছে। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে এবং তার প্রভাবে মোট জাতীয় উৎপাদনের পরিমাণও বেড়েছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণও বেড়েছে। কেবলমাত্র আমেরিকা, ব্রিটেন বা ইওরোপের অন্যান্য উন্নত দেশই নয়, আমাদের আশেপাশের দেশগুলোর সঙ্গেও বাণিজ্যের পরিবেশ ঠিক রাখতে হবে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে। তার মধ্যে ইরানও একটি উল্লেখযোগ্য দেশ। তার চাবাহার বন্দর ব্যবহার ক’রে পশ্চিম এশিয়ায় বাণিজ্য বাড়ানো, সেখান দিয়ে সরাসরি তেল সরবরাহ করার জন্য পাইপলাইনের কাজ সম্পূর্ণ করে তেল আমদানি নিশ্চিত করা ভারতের অর্থনীতির জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক।

এই সময় ইরানের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারির পর ভারত ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ রেখেছে। কিন্তু ভারত-ইরান কূটনৈতিক সম্পর্কের ৭০ বছর পূর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে দু দেশই। সেটা আজকের পরিস্থিতিতে খুবই আশাব্যঞ্জক। এই দমবন্ধ পরিবেশে নিউ দিল্লি এবং তেহরানের কাছাকাছি আসাটা ভারতের অর্থনীতির জন্য ভাল। আজকের বিশ্বায়নের আবহে গোটা বিশ্বে সুস্থির এবং শান্তি বজায় থাকা বিশ্বের অর্থনীতির জন্য খুবই প্রয়োজন।

প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ইরানের সঙ্গে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি করেছিলেন এবং ইরানের উপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়াতে তাদের আর্থিক লাভ হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে ট্রাম্প প্রশাসন এই চুক্তি বাতিল ক’রে ইরানের উপর পুনরায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারী করে। যেহেতু বর্তমানে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে তাই ইরানের হয়ত আশা, ভারত এই দু’দেশের মধ্যে মধ্যস্থতা ক’রে পুনরায় আমেরিকাকে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তির মধ্যে নিয়ে আসুক এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নিক। সেটা যদি সম্ভব হয় তাহলে বিশ্বের তেল অর্থনীতির বাজারে সুস্থিরতা আসবে এবং তার সঙ্গে গোটা বিশ্বে শান্তি বজায় থাকবে যা মানব সমাজের পক্ষে সুখকর।

কাজী নজরুল মহাবিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement