ফেসবুক শুধু বন্ধুত্বের প্ল্যাটফর্মই নয়। তার সঙ্গে সূক্ষ্মভাবে আছে সামাজিক সম্পর্ক, যোগাযোগ এবং বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের একটা বন্ধন। কিন্তু ইদানি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এর সাথে যুক্ত হয়েছে একটা দেখনদারি ব্যাপার। নিজেকে জাহির করার একটা সূক্ষ্ম মনস্তাত্বিক লড়াই, যা আপাত দৃষ্টিতে দেখা যায় না। কিন্তু অনুভব করা যায়। যিনি যা নন অথবা যিনি যা, তার থেকে বাড়িয়ে দেখানোর একটা প্রচেষ্টা। জানি না, এটা কোনও মানসিক রোগ কিনা। ডাক্তারবাবুরা ভালো বলতে পারবেন। তবে এই ধরনের মানুষজন উঠতে-বসতে, খেতে-শুতে, হাসি-কান্না, রোগ-ভোগ, এমন কী অন্দরমহলেরও ছবি পোস্ট করে থাকেন। যতক্ষণ না স্বীয় বীরত্বের অথবা নায়কত্বের সেই কর্মকান্ড পোস্ট না করতে পারেন, ততক্ষণ তাদের পেট গুড়গুড় করতে থাকে। ফেসবুকে পোস্ট না করা অবধি (অনেকে একে প্রসব বেদনার সাথে তুলনা করে থাকেন) শান্তি পান না। তারপর সেই গভীরতম অপেক্ষা। অর্থাৎ লাইক-কমেন্ট পাওয়ার অপেক্ষা। যেন বঁড়শিতে টোপ গেথে পুকুরে মাছ ধরতে বসেছেন। স্থির তাকিয়ে আছেন ফাতনার দিকে। কখন ফাতনায় ঠোকা মারবে আকাঙ্খিত মাছ। সেই আশায় বেঁধে আছেন বুক। অনেকটা এ ভাবেই তারা নেট অন করে ফেসবুক খুলে পোস্টের দিকে স্থির তাকিয়ে বসে থাকেন।
প্রসঙ্গত জানাই, ফেসবুকে লাইক-কমেন্ট ‘পাওয়া’-টা ‘দেওয়া'-র সমানুপাতিক। সোজা বাংলায় আপনি লাইক-কমেন্ট দিলে, আপনিও লাইক-কমেন্ট পাবেন। না দিলে কারও খেয়েদেয়ে কাজকর্ম নেই যে, আপনার পোস্টে তার মূল্যবান সময় নষ্ট করবে। ‘দিলে পাবেন’--- এটাই ফেসবুকের অলিখিত নীতি। আপনাকে শুধু মনে রাখতে হবে, মানুষের সময় এবং ডাটা দুটোই দামি। এ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেবের কথাটি মনে রাখা জরুরি, 'দিতে যে জানে না, পাওয়া তার ঘটে না।' ভাবতে শুরু করলাম, আমিই বা ক-টা লাইক-কমেন্ট দিই বা করি? আমি যেমন বন্ধুদের মতামত আশা করি। তারাও তো আমার কাছ থেকে কিছু আশা করতেই পারে। বন্ধু আমার সকালে কষ্ট করে উঠল। ঝোলা হাতে বাজারে গেল। মাছের বাজারের দুর্গন্ধ সহ্য করে, মাছের সাথে কায়দা করে সেলফি তুলল। অনেক দিন পর ফেসবুকে একটা ঝাক্কাস পোস্ট হয়েছে ভেবে পুলকিত হল। তার আবেগটাও বুঝতে হবে। তার আনন্দটাকেও সম্মান করতে হবে। তবে সে আপনার ভিআইপি-মার্কা পোস্টে হাত বাড়াবে। নচেৎ কাঁচকলা। আপনি যতই নোবেল প্রাইজ মার্কা লিখুন কিংবা অলিম্পিকে সোনা পাওয়া মার্কা লাফান— তাতে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কিচ্ছু যায় আসে না। সে তার নিজের ইন্টারনেট ডাটা এবং সময় ব্যয় করে থাকে। আপনার আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। মনে রাখতে হবে, ফেসবুক বানানোর পিছনে জুকারবার্গের উদ্দেশ্য। আর বন্ধুত্বটা কখনই একপক্ষের হতে পারে না।
ফেসবুকে অনেকেই পোস্ট কিংবা লেখালেখি করে থাকেন। কিন্ত লাইক, কমেন্টের সংখ্যা অত্যন্ত কম। এতে তারা অত্যন্ত বিচলিত ও চিন্তিত। বিচলিত এই ভেবে যে, তবে কি ফেসবুকের বন্ধুরা তার পোস্ট নিচ্ছে না? আসল ঘটনা কিন্তু অন্য। তিনি লাইক-কমেন্ট দেন না, তাই তিনি লাইক-কমেন্ট পান না। বাস্তব ঘটনা এটাই। এই সহজ সম্পাদ্যটি তিনি অচিরেই শিখে যান। ফলে তিনি বন্ধুদের পোস্টে লাইক-কমেন্ট দিতে শেখেন। অদ্ভুতভাবে তিনি লক্ষ্য করবেন বন্ধুরাও তার প্রতি উত্তর দিচ্ছেন। এতে বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়। অনেক অজানা অচেনা বন্ধু কাছে আসে। চেনা বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল এবং মধুর হয়। লাইক-কমেন্ট আসলে একটা সম্পর্ক। এটাকে কীভাবে আপনি ব্যবহার করবেন সেটা আপনার ব্যাপার। তবে সবকিছুরই বেশি ব্যবহারের একটি নেতিবাচক দিক আছে। সে দিকেও লক্ষ্য রাখা জরুরি। 'লাইক-কমেন্ট' প্রসঙ্গে আরও অনেক কথা মগজে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। তবে যে কথাগুলি না বললে নয়, সেটা হচ্ছে এর প্রকারভেদ। প্রকারভেদগুলি হল— ১. 'হরলিক্স' লাইক-কমেন্ট --- এটা এমনি এমনি পাওয়া যায়। শাহরুখ খান, ক্যাটরিনা কাইফ, হৃতিক রোশন, বিদ্যা বালান (কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা) ইত্যাদি স্টাররা এই ক্যাটাগরিতে পড়েন। বিখ্যাত ব্যক্তিদের গায়ে আরও রং ঢালতে কারও অসুবিধা নেই। কিছু কিছু সাধারণ ফেসবুক ব্যবহারকারী এই টাইপের 'হরলিক্স' লাইক-কমেন্ট পাওয়ার আশা করেন। বস্তুত এঁরা দিবা স্বপ্নের মধ্যে বাস করেন। কোনও দিনই তাদের স্বপ্ন পূরণ হয় না বা হবে না। বলাবাহুল্যই এরা 'নেওয়া' প্রজাতির।
২. 'ধামাধরা' লাইক-কমেন্ট— তেলযুক্ত হওয়ায় অতিশয় চকচক করে। তাই সহজেই মানুষের নজরে পড়ে এবং তার থেকেও সহজে একে শনাক্ত করা যায়। অফিসের বস, উচ্চপদস্থ অফিসার, নেতা-মন্ত্রী, কিছু ক্ষেত্রে সম্পাদক-প্রকাশক— এই ধরনের লাইক-কমেন্ট পেয়ে থাকেন। দাতারা কারা তা সকলেই চেনেন এবং জানেন। তাই বেশি ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।
৩. 'গিভ এন্ড টেক' লাইক-কমেন্ট — দিলে পাওয়া যায়, না দিলে পাওয়া যায় না। এটা সহজ এবং সরল পদ্ধতি। এটারও অনেক গুপ্ত রসায়ন আছে। মাথা খেলালেই মগজধারীরা বুঝতে পারবেন। তাই হাটে হাঁড়ি ভাঙার প্রয়োজন নেই। বুদ্ধিমানদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। তবে এটা অবশ্যই কার্যকর পদ্ধতি।
৪. 'দেবদাস' লাইক-কমেন্ট— কোনও পোস্ট পড়ে কিংবা ছবি দেখে ফিদা হয়ে গেলে এই ধরনের লাইক-কমেন্ট পড়ে। এই লাইক-কমেন্ট-এ নেশা থাকে। যেহেতু নেশা থাকে, তাই দাতারা একশো শতাংশ সৎ হৃদয়ে এটা দেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এটা প্রেমে পড়ার প্রাথমিক লক্ষণও বটে। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের মূল্যবান নানা গবেষণা আছে। সুতরাং আমাদের মতো মানুষের মোড়লি না করলেও চলবে।
৫. 'চাতক' টাইপের লাইক-কমেন্ট — এটা আসলে দিল্লি কা লাড্ডু। ফেসবুকিরা পোস্ট সাঁটিয়ে অপেক্ষায় বসে থাকেন। নিজেকে মার্কামারা ভিআইপি ভেবে স্বপ্ন দেখেন লাইক-কমেন্ট-এর বন্যা বয়ে যাবে। ফেসবুকে তার বন্ধুরা ধন্য ধন্য করবেন। যা আদতে কখনই ঘটে না। তবে এরা খুবই আশাবাদী টাইপের হয়। বারংবার ফেল করলেও, এদের চেষ্টার ত্রুটি থাকে না।
৬. 'বিছুটি' টাইপের লাইক-কমেন্ট — এটার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। দাতাদের এই লাইক-কমেন্ট-এ থাকে বিছুটির জ্বলুনি। এদের প্রধান কাজ হল অন্যের গায়ে চিমটি কাটা। এরা ঈর্ষাপরায়ণ, হিংসুটে কিংবা কাঠিপ্রদানকারী হয়ে থাকেন । অন্যের গায়ে চিমটি কাটতে এঁদের জুড়ি নেই ।
এ ছাড়াও আরও অনেক ড্যাশ ড্যাশ টাইপের লাইক-কমেন্ট হতে পারে। পাঠক-পাঠিকাদের মনে অনেক ধরনের লাইক-কমেন্ট উঠে আসতে পারে। তাই এগুলি ছাড়াও যদি কিছু প্রকারভেদ বা পয়েন্ট যদি মনে আসে, সেগুলি ইচ্ছে মতো যোগ করে নিতে পারেন।
মতামত লেখকের নিজস্ব