শ্রমিকদের সঙ্কটের সময়ে হঠাৎ সুখবর এল দুই রাজ্য থেকে। ফাইল চিত্র।
মাথার উপরে শ্রম কোডের খাঁড়া, সামনে বেকারত্বের খাদ— শ্রমিকদের এই সঙ্কটের সময়ে হঠাৎ সুখবর এল দুই রাজ্য থেকে। রাজস্থান সরকার এক লক্ষ দশ হাজার ঠিকা-চুক্তি কর্মীকে নিয়মিত কর্মচারী হিসাবে নিয়োগ করতে চলেছে। মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, চুক্তিতে নিযুক্ত কর্মীরা উন্নয়নের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, কিন্তু তাঁদের স্বীকৃতি মেলে না। নতুন নিয়মে রাজস্থানে অন্তত পাঁচ বছর কাজ করলে নিয়মিত কর্মচারী হওয়ার জন্য গণ্য হবেন ঠিকা কর্মীরা। ঠিকা কর্মীদের মজুরি নির্ধারণ করা হবে ‘সমকাজে সমবেতন’ নীতি মেনে, অর্থাৎ একই পদে নিয়মিত সরকারি কর্মীদের বেতনের সমান হারে। ঠিকা নিয়োগেও সংরক্ষণ প্রথা মেনে চলা হবে। এ ছাড়া ঠিকা কর্মীদের পারিশ্রমিকও ২০ শতাংশ বাড়ানোর জন্য বাড়তি টাকা মঞ্জুর করা হয়েছে ২০২২-২৩ সালের বাজেটে।
আরও বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওড়িশা সরকার। মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক ঘোষণা করেছেন, ওড়িশা সরকার আর কোনও ঠিকা কর্মী নিয়োগ করবে না। যা নিয়োগ হবে, সব স্থায়ী পদে। বর্তমানে ওড়িশা সরকারের অধীনে কর্মরত ৫৭ হাজার ঠিকা কর্মীর সকলকেই স্থায়ী সরকারি কর্মী হিসেবে নিয়োগ করা হবে। এ জন্য বছরে ১৩ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচের অনুমোদনও করেছে ওড়িশার মন্ত্রিসভা। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, একটি স্থায়ী সরকারি চাকরির জন্য ওড়িশার যুবক-যুবতীদের আকুতি তাঁকে বিচলিত করেছে। তাই এই সিদ্ধান্ত। প্রসঙ্গত, গত সেপ্টেম্বর মাসে ঠিকাপ্রথা বিলোপ ও সমকাজে সমবেতনের দাবিতে গোটা ওড়িশা জুড়ে তুমুল বিক্ষোভ আন্দোলন সংগঠিত করে ওড়িশা সরকারের ঠিকা কর্মচারী সমিতি। এই সমিতির সদস্য চুক্তিতে নিযুক্ত শিক্ষক, পুলিশ, গ্রুপ সি সরকারি কর্মচারী-সহ অন্য কর্মীরা। সরকারের সিদ্ধান্তের পিছনে এই আন্দোলনের ভূমিকা থাকতেও পারে।
এই দুই রাজ্যে দুই ভিন্ন দলের, ভিন্ন অবস্থানের সরকার। ওড়িশায় বিজেডি সরকার দীর্ঘ দিন কেন্দ্রের বিজেপির সহযোগী ছিল, বরাবরই কংগ্রেসের বিরোধিতা করে এসেছে। অন্য দিকে, রাজস্থানে এখন কংগ্রেসের সরকার। তা সত্ত্বেও দুই রাজ্যেই ঠিকা কর্মীদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ ও তরুণদের স্থায়ী চাকরির দাবি মান্যতা পেয়েছে, এটা লক্ষণীয়। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের অধীন চুক্তিতে নিযুক্ত ‘ক্যাজ়ুয়াল’ কর্মচারীদের অবস্থা। এ রাজ্যে স্থায়ী কর্মী নিয়োগ কার্যত বন্ধ। লক্ষাধিক সিভিক পুলিশের কাজ থাকা না-থাকা নির্ভর করে রাজনৈতিক নেতা বা পুলিশের আইসি-র মর্জির উপর। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, এই দুই বিভাগ মিলিয়ে কয়েক লক্ষ চুক্তি-ভিত্তিক কর্মী রয়েছেন, তাঁদের না আছে প্রভিডেন্ট ফান্ড, না গ্র্যাচুইটি, না আছে ন্যূনতম মজুরির বালাই।
লাভের মধ্যে, সম্প্রতি রাজ্য সরকার একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে যে, রাজ্য সরকারের বরাত নিয়ে যে ঠিকাদার সংস্থাগুলি কাজ করে, তারা যেন ঠিকা কর্মীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং ইএসআই-এর অধীনে নিয়ে আসে। এটা বস্তুত আইন মেনে কাজ করার নির্দেশ, তার বেশি কিছু নয়। সম্প্রতি রাজ্যের কিছু শ্রমিক সংগঠন সব ঠিকা কর্মীকে প্রভিডেন্ট ফান্ডের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে শ্রম সচিবের কাছে। ঠিকা কর্মীদের নিয়মিত কর্মী হিসাবে নিয়োগের দাবি ইউনিয়নের দাবিপত্রে থাকে, হয়তো চল্লিশটা দাবির তালিকায় ঊনচল্লিশ নম্বর দাবি হিসাবে। স্থায়ী কর্মীদের ডিএ আদায়ের আন্দোলনে অস্থায়ী ঠিকা কর্মীদের দেখা যায় পদাতিক বাহিনীর ভূমিকায়। এ ভাবেই চলছে বছরের পর বছর।
কেন্দ্রীয় সরকারি দফতরগুলিতেও স্থায়ী নিয়োগ কমেছে। ‘টেম্পোরারি’, ‘ক্যাজ়ুয়াল’, ‘ডেলি-পেড’— এমন নানা নামে প্রচুর ঠিকা কর্মী নিযুক্ত হচ্ছেন। সুপ্রিম কোর্টের রায় আছে, অস্থায়ীদের বেতন দিতে হবে স্থায়ী কর্মীদের সমহারে। কেন্দ্রীয় শুল্ক দফতরের কিছু কর্মী দীর্ঘ আন্দোলন করে সমান হারে মজুরি আদায়ও করেছেন। অতীতে বহু কর্মী চুক্তিতে কাজ শুরু করার পর স্থায়ীও হয়েছেন। কিন্তু গত দশ বছরে দেখা যাচ্ছে, নতুন নিয়োগ কার্যত নেই। সরকারি ব্যাঙ্ক, সমবায়গুলিতেও এখন বিপুলসংখ্যক চুক্তি-ভিত্তিক কর্মী কাজ করছেন। এক দশক আগে প্রায় সব কর্মীই কিন্তু স্থায়ী ছিলেন।
ঠিকায় কর্মী নিয়োগ করলে বরাত অনুসারে কর্মী-সংখ্যা স্থির করার নমনীয়তা থাকে। কিন্তু ঠিকা নিয়োগের সুযোগ নিয়ে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিধিগুলি লঙ্ঘন করার ঘটনা খুবই বেশি। চটকলের মতো সংগঠিত শিল্পেও দক্ষ, প্রশিক্ষিত কর্মীরা স্থায়ী নিয়োগ, ন্যায্য মজুরি না পেয়ে অন্য রাজ্যে দিনমজুরি করছেন। এমনকি সরকারও আইন মানে না। হতে পারে, ওড়িশা ও রাজস্থান সরকারের সিদ্ধান্ত নির্বাচনমুখী। সংসদীয় গণতন্ত্রে এটাই তো স্বাভাবিক। সরকার যদি ঠিকা কর্মীদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা দেয়, এবং কাজের প্রয়োজন অনুসারে স্থায়ী নিয়োগ করে, তা হলে বেসরকারি ক্ষেত্রকেও সজাগ হতে হবে। ওড়িশা ও রাজস্থান সরকারকে অভিনন্দন জানানো বিধেয়।