বর্তমানে পৃথিবীর সমস্ত খেলায় গোটা দলকে নিয়মিত কোভিড পরীক্ষা করতে হয়। এই নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষা হওয়ায় কিছু দিন আগে দেখা গেল নিউ ইয়র্ক-এর বেসবল দলের তিন জন খেলোয়াড় কোভিড পজ়িটিভ। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এঁরা প্রত্যেকেই এক মাস আগে প্রতিষেধকের দ্বিতীয় ডোজ় নিয়েছেন। গোটা আমেরিকাতে আরও কয়েকটি ক্ষেত্রেও দেখা গেল, প্রতিষেধক নেওয়ার পরেও কিছুসংখ্যক মানুষ কোভিড পজ়িটিভ হলেন। যদিও সব ক্ষেত্রেই সংক্রমণের মাত্রা খুব কম এবং বিশেষ কোনও বাহ্যিক লক্ষণ দেখা যায়নি। কিন্তু এমনটা হওয়ার কারণ কী? তা হলে কি প্রতিষেধক কাজ করছে না? আজকাল সংবাদপত্রে বা টেলিভিশনে এমন খবর ফলাও করে বেরোলে আশঙ্কা হয়— হয়তো কারও ক্ষেত্রেই প্রতিষেধক আদৌ কাজ করছে না! আসলে এটা হল ‘ব্রেকথ্রু ইনফেকশন’-এর উদাহরণ। যখন কোনও রোগের প্রতিষেধক নেওয়ার পরেও কেউ সেই রোগে আক্রান্ত হন বা সংক্রমণের অল্প-বিস্তর উপসর্গ দেখা দিতে থাকে, তখন তাকে বলা হয় ব্রেকথ্রু ইনফেকশন। প্রতিষেধকের ইতিহাসে ব্রেকথ্রু ইনফেকশনের একাধিক নজির রয়েছে। এই ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বর্তমানে কোভিড-এর ব্রেকথ্রু ইনফেকশন সম্পর্কে কতটুকু তথ্য আমরা জানি? এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিটাই বা কী?
ফাইজ়ার আর মডার্না-র প্রতিষেধক যখন প্রথম বাজারে আসে, তখন তাদের কোভিড প্রতিরোধের ক্ষমতা ৯৫ শতাংশ বলে প্রমাণিত হয়েছিল। প্রতিষেধকের ক্ষেত্রে এটা অসামান্য সাফল্য। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে, প্রতিষেধক নিলেই যে ১০০ শতাংশ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠবে, এই ধারণা শুরু থেকেই ভ্রান্ত। এটাও আমাদের জানা যে, প্রতিটা মানুষের প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ‘ইমিউনিটি’ আলাদা। এর সহজ উদাহরণ হল, অনেকেরই সহজে ঠান্ডা লাগে, আবার কারও ঠান্ডা লাগেই না। তাই প্রতিষেধক নেওয়ার পরেও যে সবার শরীরে সমান পরিমাণে ভাইরাস প্রতিরোধক অ্যান্টিবডি তৈরি হবে না, সেটাই স্বাভাবিক। প্রতিষেধক আসলে কাজ করে বর্মের মতো। বর্ম পরলে হয়তো তিরের ফলা সহজে শরীর ভেদ করবে না। কিন্তু তা থেকে সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা আশা করা যায় না। ঠিক তেমনই, প্রতিষেধক নেওয়ার পরেও কোনও কোনও ক্ষেত্রে কোভিড পজ়িটিভ রোগী দেখা যাচ্ছে। কিন্তু একটা কথা পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন: এই ব্রেকথ্রু ইনফেকশন-এর হার খুবই কম। মাত্র ০.০০০১ শতাংশ।
ভারতে ইদানীং ডেল্টা বা কাপ্পা-র মতো কোভিডের বিভিন্ন প্রতিরূপ বা ভেরিয়্যান্ট-এর প্রকোপ দেখা গিয়েছে। প্রশ্ন হল, প্রতিষেধক কি এই সমস্ত ভেরিয়্যান্ট-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে? ব্রেকথ্রু ইনফেকশন-এর নেপথ্যেও কি বিভিন্ন ভেরিয়্যান্ট? ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গিয়েছে, ফাইজ়ার-এর প্রতিষেধক ডেল্টা ভেরিয়্যান্ট-এর বিরুদ্ধে ৯৫ শতাংশ না হলেও প্রায় ৯০ শতাংশ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তবে মডার্না-র প্রতিষেধক আগের মতোই ডেল্টা-র বিরুদ্ধেও ৯৫ শতাংশ প্রতিরোধ ক্ষমতা দেখিয়েছে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে প্রচলিত কোভ্যাক্সিন ও কোভিশিল্ডও ডেল্টা ভেরিয়্যান্ট-এর বিরুদ্ধে আশানুরূপ কার্যকর। বোঝাই যাচ্ছে যে, বাজারে প্রচলিত সমস্ত প্রতিষেধকই অতিসংক্রামক কোভিড ভেরিয়্যান্টগুলোর বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রতিরোধ ক্ষমতা জোগান দেবে। যদিও প্রতিরোধের ব্যাপ্তি প্রতিটি প্রতিষেধকের ক্ষেত্রে আলাদা হবে।
কিন্তু প্রতিষেধক নিলেও যদি কোভিড হয়, তা হলে প্রতিষেধক নেওয়ার প্রয়োজন কী? এই প্রশ্নের উত্তরও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল থেকেই পাওয়া যায়। ডেল্টা ভেরিয়্যান্ট-এর ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, প্রতিষেধক না নিলে সংক্রমণের আশঙ্কা ১১ গুণ বেড়ে যায়। তাই মৃত্যুর হারও সেই অনুপাতে সাংঘাতিক ভাবে বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া দেখা যাচ্ছে যে, বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি কোভিড-আক্রান্ত ৯৯ শতাংশ রোগীরই প্রতিষেধক নেওয়া হয়নি, বা দুটো ডোজ় সম্পূর্ণ হয়নি। প্রতিষেধক নিয়ে কোভিডে আক্রান্ত হলেও বা অল্প-বিস্তর লক্ষণ দেখা দিলেও, প্রায় কোনও ক্ষেত্রেই হাসপাতালে যেতে হচ্ছে না। ইদানীং মিউ ভেরিয়্যান্ট-এর কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিষেধক এই সদ্য রূপান্তরিত ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করবে কি না, সে বিষয়ে সঠিক তথ্য এখনও জানা নেই। আলফা, বিটা, গামা, ডেল্টা আর কাপ্পা কোভিড ভাইরাসের ছয় নম্বর তুতোভাই হল এই মিউ ভেরিয়্যান্ট। এখনও পর্যন্ত ৩৯টি দেশে দেখা গিয়েছে। যদিও সারা পৃথিবীর গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মিউ-এর উপর নজর রেখে চলেছেন, এখনও পর্যন্ত ডেল্টা-ই হল সবচেয়ে সংক্রামক। সব ক’টি প্রতিষেধকই ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন-এর বিরুদ্ধে নির্মিত হয়েছে, এবং কোভিড ভাইরাসের সব ভেরিয়্যান্ট-ই এই স্পাইক প্রোটিনের মিউটেশনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, সমস্ত প্রতিষেধকই মিউ-এর বিরুদ্ধেও কাজ করবে। যদিও কোন প্রতিষেধক কত শতাংশ কার্যকর হবে, তা আগে থেকে অনুমান করা সম্ভব নয়।
স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের মনে আরও একটা প্রশ্ন জাগছে— প্রতিষেধক কত দিন পর্যন্ত ফলদায়ক থাকবে? কয়েক মাস, কয়েক বছর, না কি সারা জীবনের জন্য? যেমন, হাম-এর প্রতিষেধক সারা জীবন প্রতিরোধ ক্ষমতা জোগায়, অথচ ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্ষেত্রে তা প্রতি বছর নিতে হয়। কারণ, এই উত্তরের উপর অনেকটাই নির্ভর করছে মানুষ কত তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে। এখনও পর্যন্ত যা তথ্য পাওয়া গিয়েছে, তাতে মনে করা হচ্ছে যে, ফাইজ়ার-এর প্রতিষেধক কমপক্ষে আট মাস পর্যন্ত কার্যকর থাকছে। তবে এই নিয়ে এখন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে তুমুল বিতর্ক চলেছে। এখনই ঠিক বোঝা যাচ্ছে না যে, একটি ‘বুস্টার ডোজ়’ প্রয়োজন হলেও তা প্রথম ডোজ় নেওয়ার কত দিন পরে নিতে হবে। আশা করা যায় যে, আর কয়েক মাসের মধ্যে এই বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে।
কিন্তু যদি কোনও কারণে সাধারণ প্রতিরোধক ক্ষমতা বা ইমিউনিটি-র ঘাটতি হয় (যেমন ক্যানসার হলে) তা হলে? বিশেষজ্ঞদের মত: তা হলে ৮-১০ মাসের মধ্যেই বুস্টার ডোজ় নেওয়া উচিত। প্রতিষেধকের প্রধান কাজ হল মানুষের শরীরের সাধারণ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করা। কিন্তু ভাইরাস যত দ্রুত নিজেকে বদলাবে বা মিউটেট করবে, তত তাড়াতাড়ি প্রতিষেধকের কার্যকারিতাও কমে যাবে। পাশাপাশি সাধারণ প্রতিরোধ ক্ষমতাও সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে ক্রমশ অকেজো হয়ে পড়বে। কোভিড ভাইরাস হাম-এর ভাইরাসের মতন স্থায়ী নয়, আবার ইনফ্লুয়েঞ্জা-র মতো ঘন ঘন পরিবর্তিতও হয় না। তাই মনে করা হচ্ছে যে, হয়তো কোভিড-এর প্রতিষেধক প্রতি দেড় থেকে দুই বছর অন্তর নিতে হতে পারে। তবে এই বিষয়ে এখনও গবেষণা চলেছে। কিন্তু এ কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে, যত দ্রুত ও যত বেশি সংখ্যায় সারা বিশ্বের মানুষকে প্রতিষেধক দেওয়া যাবে, তত তাড়াতাড়ি সংক্রমণের অগ্রগতি রোধ করা যাবে। আর সংক্রমণ বন্ধ হলেই ভাইরাসের মিউটেশনও বন্ধ হবে। কিন্তু বিপরীতে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে নতুন নতুন মিউটেশনও অনিবার্য ভাবে দেখা দেবে— সেটাই অধিকাংশ ভাইরাসের স্বাভাবিক জীবন ধারা। আশঙ্কার বিষয় হল, ভবিষ্যতে এমন কোনও মিউটেশন দেখা দিতেই পারে যার বিরুদ্ধে চলতি কোনও প্রতিষেধক কাজ করবে না। তেমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই দ্রুত জনসংখ্যার সিংহভাগকে প্রতিষেধকের বর্মে মুড়ে ফেলতে হবে।
প্রতিষেধক নিয়ে নানা দেশে কুসংস্কার ও মিথ্যা রটনা ক্রমাগত প্রচারিত হচ্ছে, বিশেষ করে সমাজমাধ্যমের হাত ধরে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যেন জনসাধারণ এই ফাঁদে পা না দেয়। আমাদের আপনজন আর পরের প্রজন্মের স্বার্থে প্রকৃত বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই কিন্তু এই অতিমারি পরিস্থিতি থেকে আমাদের মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায়।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ,
ওয়াশিংটন ডি সি