Women Empowerment

কী আশায় বুক বাঁধা যায়?

অতিমারি ভারতের মেয়েদের বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে— মেয়েরা বেশি কাজ হারিয়েছেন, গৃহহিংসা বেড়েছে, ঘর থেকে কাজ করার জন্য কাজের বোঝা দ্বিগুণ হয়েছে।

Advertisement

রীতিকা খেরা

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২১ ০৪:৫০
Share:

নতুন আর্থিক বছর শুরু হল, সরকার যার অর্থনৈতিক রূপরেখা ঘোষণা করেছে বাজেটে। মেয়েরা কী আশা করতে পারেন এ বছর? প্রশ্নটা সহজ নয়, কারণ বাজেটে যা কিছু ঘোষণা হয়, তার সবই মেয়েদের দৃষ্টিতে জরুরি। তবু এ-ও লক্ষ না করে পারা যায় না যে, ৬৫-পাতা বাজেট বক্তৃতায় ‘মেয়েরা’ (উইমেন) শব্দটা রয়েছে কেবল সাত বার। ‘মেয়ে’ (উয়োম্যান), ‘বালিকা’ (গার্ল) কিংবা ‘লিঙ্গ’ (জেন্ডার) এক বারও আসেনি। সে তুলনায়, ‘পরিকাঠামো’ (ইনফ্রাস্ট্রাকচার) উল্লিখিত হয়েছে ৫৭ বার।

Advertisement

যে বিষয়ে বরাদ্দের প্রতি মেয়েদের সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়ার কথা, তা হল শিক্ষা। শিক্ষা—এমনকি বুনিয়াদি শিক্ষাও— মেয়েদের অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতিতে যোগদানের ক্ষমতা তৈরি করে। নানা তথ্য-প্রমাণ থেকে আমরা জানি যে, মেয়েরা সরকারি স্কুলে ভর্তি হয় বেশি, ছেলেরা প্রাইভেট স্কুলে। গত আর্থিক বছরে স্কুলশিক্ষার বাজেট ছিল ৬০,০০০ কোটি টাকার মতো, এ বছর যা কমে হয়েছে ৫৫,০০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। মিড-ডে মিল স্কুলগুলোতে ছেলে-মেয়ের সংখ্যায় সমতা এনেছিল, ক্লাসে উপস্থিতি বাড়িয়েছিল। সেখানেও বাস্তবিক বাজেট কমেছে ৩৮ শতাংশ, যদি ২০১৪-১৫’র সঙ্গে তুলনা করা হয় ২০২১-২২’এর। উচ্চশিক্ষাতেও বরাদ্দ কমেছে দু’হাজার কোটি টাকা।

অবশ্যই তাকানো প্রয়োজন নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রকের দিকে। এই মন্ত্রকের দু’টি প্রধান প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী মাতৃবন্দনা যোজনা এবং অঙ্গনওয়াড়ি (আইসিডিএস)। এর প্রথমটি সব মহিলাকে প্রথম সন্তানের জন্মের পর পাঁচ হাজার টাকা অনুদান দেয়। আমরা যারা সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করি, তারা অনুদানের সঙ্গে ছ’মাস সবেতন ছুটি পাই। একই নীতি অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা, যাঁদের ছুটি আরও বেশি প্রয়োজন, তাঁদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় না। যাঁদের অবস্থা ভাল, তাঁরা আরও বেশি সহায়তা পেলেন; যাঁরা বিপন্ন, তাঁরা কম। গত বাজেটে এই অনুদানের জন্য ২৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তার মাত্র ১৩০০ কোটি খরচ হয়েছে। গত বছর অতিমারির ফলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের বহু কর্মী কাজ হারিয়েছেন, আরও অনেকের রোজগার কমেছে। তাই অল্প হলেও এই নগদ অনুদানের সহায়তা খুবই জরুরি ছিল। কিন্তু দেখাই যাচ্ছে, প্রকল্পের যাঁরা লক্ষ্য ছিলেন, তাঁদের কাছে সরকার পৌঁছতে পারেনি। এ বছর মাতৃবন্দনা প্রকল্পের বাজেট বরাদ্দ আরও তিনটি প্রকল্পের সঙ্গে জুড়ে ‘সামর্থ্য’ নাম দেওয়া হয়েছে। অথচ দেখা যাচ্ছে, ‘সামর্থ্য’-র জন্য যা বরাদ্দ, ২০২০-২১ সালে মাতৃবন্দনা যোজনার জন্যও তা বরাদ্দ ছিল।

Advertisement

আইসিডিএস-এর ক্ষেত্রে আমরা একই নকশা দেখছি। ২০২১-২২ সালে ২০,৩৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে দেখানো হয়েছে ১৭,২৫২ কোটি টাকা। আইসিডিএস-এর বাজেটও আরও তিনটি প্রকল্পের সঙ্গে জুড়ে (নতুন নাম, ‘সক্ষম’) দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার জন্য ২০২১-২২ সালে যে বরাদ্দ, তা গত বাজেটে অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পের বরাদ্দের চেয়ে কম।

যা আরও উদ্বেগজনক তা হল, যদি মূল্যস্ফীতির হিসেব ধরে বিচার করা হয়, তা হলে দেখা যাবে যে, বেশ কয়েক বছর ধরে এই অত্যন্ত জরুরি প্রকল্পটির জন্য অনুদান ক্রমশ কমছে। ২০১৪-১৫ সালে আইসিডিএস বাজেট ছিল ১৮,৬৯১ কোটি টাকা। পাঁচ শতাংশ হারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে ধরে নিলে আজ সেটা দাঁড়ায় ২৬,৩০০ কোটি টাকা। কিন্তু সক্ষম-এর মধ্যে আইসিডিএস-এর অংশ ধরলে দেখা যাবে, ২০১৪-১৫ সালের তুলনায় তা ৩৬ শতাংশ কম।

কিন্তু মিডিয়াতে মেয়েদের দৃষ্টিতে বাজেট বিচার করলে প্রধানত নির্ভয়া ফান্ড কিংবা রান্নার গ্যাসের কথাই বলা হয় বেশি। মেয়েদের উপর যৌন নির্যাতনের প্রতিরোধ ও প্রতিকারের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে গঠিত নির্ভয়া তহবিলের টাকা যে আশানুযায়ী খরচ হচ্ছে না, এবং জরুরি বিষয়গুলি অগ্রাধিকার পাচ্ছে না, সে কথা গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে।

সরকারের অন্যতম প্রধান প্রকল্প ‘উজ্জ্বলা’, তার কথা না তুললে তো মেয়েদের দৃষ্টিতে বাজেটের আলোচনা সম্পূর্ণ হতেই পারে না। মেয়েদেরই যে হেতু প্রধানত রান্না করতে হয়, তাই কাঠ জ্বালানোর অস্বাস্থ্যকর ধোঁয়া থেকে মুক্তি, এবং রান্নার গ্যাসের মতো দূষণহীন জ্বালানি মেয়েদের সুরক্ষিত করবে, এ কথা বলা যায়। এই প্রকল্পের সুবিধে, সিলিন্ডারের জন্য টাকা জমা রাখতে হয় না, স্টোভের দাম এবং প্রথম সিলিন্ডারের দাম মাসে মাসে কিস্তিতে দেওয়া যায়। কিন্তু গ্যাসের দাম বাড়ায় বহু ‘উজ্জ্বলা গৃহস্থালি’ গ্যাসের ব্যবহার চালিয়ে যেতে পারছে না।

পুরুষ-মহিলা সাম্যের নিরিখে ভারত পিছিয়ে— সম্প্রতি লিঙ্গবৈষম্যের সূচকে ভারতের স্থান হয়েছে ১৪০, মোট ১৫৬টি দেশের মধ্যে। আগের বছরের তুলনায় ২৮ ধাপ পিছিয়ে গিয়েছে ভারত। কোভিড অতিমারি ভারতের মেয়েদের বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে— মেয়েরা বেশি কাজ হারিয়েছেন, ডিজিটাল প্রযুক্তির নাগাল না পাওয়াতে মেয়েদের পড়াশোনার বেশি ক্ষতি হয়েছে, গৃহহিংসা বেড়েছে, ঘর থেকে কাজ করার জন্য কাজের বোঝা দ্বিগুণ হয়েছে, চিকিৎসা পেতে সমস্যা মেয়েদেরই বেশি হয়েছে। এ সব থেকে এ বছর রেহাই মিলবে, বাজেটের দিকে তাকালে সে ভরসা মেলে না।

অর্থনীতি বিভাগ, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, দিল্লি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement