Durga Puja 2023

পুজোর গন্ধ আর পূজাবার্ষিকী

নিত্য দিনের খবরের কাগজ, বেশি বিখ্যাত, কম বিখ্যাত লিটল ম্যাগাজ়িন সবই পুজোর জন্য অপেক্ষায় থাকে। নিউজ় স্ট্যান্ডের কাগজবিক্রেতা বিশেষ ভাবে উৎসাহিত থাকেন।

Advertisement

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৩ ০৬:১৪
Share:

পূজাবার্ষিকী। —ফাইল চিত্র।

পুজো আসছে। কারও কাছে অর্থনৈতিক কারণে, কারও কাছে ধর্মীয় কারণে, কারও জন্য কেবল উৎসবের আমেজে— এ একটা অন্য রকম সময়। এ নেহাত নিরবয়ব আনন্দ-অনুভূতি নয়, একটা বাস্তব ভিত্তি-সমেত প্রতি বছর আসে এই অনুভূতি। বাৎসরিক অর্থনীতির চক্রও তার খুঁটি স্থাপন করে এই বৎসরকালীন উৎসবকে কেন্দ্র করে।

Advertisement

যে কোনও উৎসব উদ্‌যাপনের এই উপাদনগত ভিত্তি তৈরি হয় উৎসবকে কেন্দ্র করে, তৈরি হয় তার সামাজিক পরিচয়, বা সোশ্যাল আইডেন্টিটি। জায়গার-মাইক্লেটান তত্ত্ব অনুযায়ী শুধু উৎসব নয়, তার এই স্পর্শগ্রাহ্য উপাদানগুলিই সামাজিক পরিচয় ও ‘বিলঙ্গিং’-এর ভাবধারা তৈরি করে আমাদের মনস্তত্ত্বে। দুর্গাপুজোও ঠিক তাই। সেই উপাদানগুলি নিজেরা হয়তো পুজোর প্রত্যক্ষ উপাদান নয়, তবু তাদের ছাড়া পুজোর কথা কেউ ভাবতেও পারে না। শিউলিফুল ছাড়া, গানের সুর ছাড়া, বাঁশের মোড়কে ঢাকা পড়তে থাকা শহর ছাড়া। ঢাকের আওয়াজ ছাড়া— যে ঢাক পু়জোর উপাদান না কি অনুষঙ্গ, তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে। পুজোর বিজ্ঞাপন ছাড়া— যা শহরের মুখ ঢেকে দেয়, জানান দেয় পুজো আসছে।

এমনই আর এক উপাদান, অনস্বীকার্য উপাদান— পূজাবার্ষিকী। হয়তো এই অনুভূতি সর্বজনীন নয়, তবু যে অর্থনীতির সামগ্রিকতার কথা বলা হয়েছে শুরুতেই, তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে পারে সমগ্র আর্থ-সামাজিক বৃত্তে। অর্থনীতির তকমায় কেউ ভোক্তা হয়ে যুক্ত, কেউ উৎপাদক হয়ে। কেউ বা দুইয়ের মাঝের যোগসূত্র হয়ে সম্পূর্ণ করে এই বৃত্ত।

Advertisement

নিত্য দিনের খবরের কাগজ, বেশি বিখ্যাত, কম বিখ্যাত লিটল ম্যাগাজ়িন সবই পুজোর জন্য অপেক্ষায় থাকে। নিউজ় স্ট্যান্ডের কাগজবিক্রেতা বিশেষ ভাবে উৎসাহিত থাকেন। “কাল বছরের প্রথম পূজাবার্ষিকী হাতে আসবে, দিদি।” পূজাবার্ষিকীকে উপলক্ষ করে তাঁর নিয়মিত কেনাবেচার বাইরে বেশ কিছু বিক্রিবাটা হয়। সকালে যখন পূজাবার্ষিকী সংগ্রহ করতে গেলাম, তিনি মন দিয়ে প্রিয় লেখকের উপন্যাসটি পড়ছিলেন। হয়তো দীর্ঘ দিন এই বৃত্তের সঙ্গে যুক্ত, তাই বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন বিক্রির ভবিষ্যৎ। যে সংখ্যাটি পড়ছিলেন, সেটা এক পাশে সরিয়ে রেখে আনকোরা প্যাকেটবন্দি সংখ্যা দিলেন। এক মুহূর্তে পাঠক থেকে বিক্রেতা হয়ে গেলেন তিনি। এই কাগজ বিক্রেতা এখানে কী? তিনি শুধু বিক্রির সঙ্গে যুক্ত, উৎপাদনের সঙ্গে নয়, তাই তিনি উৎপাদক নন? বইটি পড়ছিলেন, কিন্তু অর্থের বিনিময়ে কিনে তো পড়ছিলেন না, তাই ভোক্তা বা কনজ়িউমার নন?

অর্থনীতির তত্ত্ব যা-ই বলুক, পূজাবার্ষিকী তৈরি হওয়া, বিক্রি হওয়া, পাঠকের হাতে আসা, পাঠকের ভাল লাগা বা না লাগা, কোনও লেখকের জনপ্রিয়তার প্রেক্ষাপট তৈরি হওয়া, পূজাবার্ষিকী সঙ্গে করে নিয়ে আসে বেশ কিছু বাস্তব কেজো হিসাব। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে পুজোর এই ‘ক্রিয়েটিভ ইকনমি’র মূল্যায়ন ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এই ক্রিয়েটিভ ইকনমির এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পূজাবার্ষিকীর উৎপাদন ও বিক্রয়। আর সেই হিসাবের বাইরে, উপাদানগত ভিত্তির বাইরে থেকে যায় আরও না-মেলা অঙ্ক। সমাজতত্ত্ববিদরা এর এক রকম ব্যাখ্যা দেবেন, মনস্তত্ত্ববিদরা আর এক রকম— তবে উৎসব মানুষের মনে তৈরি করে এক আশ্চর্য ভাল লাগার অনুভূতি, যাকে বলে ‘ফেস্টিভ্যাল ওয়েলবিয়িং’। আর এই আনন্দের থেকে জন্ম হয় পুজোগন্ধের এই ‘কনস্ট্রাক্ট’।

প্রশ্ন আসতেই পারে, যে উত্তেজনা বা ভাল লাগার কথা আমরা ভাবছি, সে কি সত্যিই সবার? যেমন পূজাবার্ষিকীর অনুষঙ্গ— কতটা বিস্তৃত আজ এর পরিধি, কতটা গভীর? এখন কি আর তেমন ভাবে কেউ পূজাসংখ্যা পড়ে, তেমন অপেক্ষা করে? যারা করে, তারা কি পুরনো দিনের কথা মনে করেই এখনও তার আঁচে মন জুড়ায়?

পুজো-সংখ্যার বিষয়টি ভাবার মতোই, কেননা এই আক্ষেপ তো আমরাই করি, আজকাল কি কেউ বই পড়ে? অল্পবয়সিরা কিছু পড়ে কি? বিশেষত বাংলা বই? না কি আমরাই ভুল করছি? যাদের কথা ভাবছি তারা না পড়লেও, ‘কেউ’ পড়ে? হাতে নিয়ে না পড়লেও ফোনের সাহায্যে পড়ে? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়, অধ্যাপক ও অভিভাবক হয়ে দেখছি, আজও আপাদমস্তক ইংরেজি মাধ্যমে পড়া, দক্ষিণ কলকাতার নামী কলেজে অর্থনীতির ছাত্রী ক্লাসের শেষে দাঁড়িয়ে আছে প্রশ্ন নিয়ে। অর্থনীতির প্রশ্ন নয়, পূজাবার্ষিকীর কোন লেখাটি তার ভাল লেগেছে, তাই নিয়ে কি সে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারে? এ কি ব্যতিক্রম? না কি এ রকমও একটা ধারা আছে?

অর্থনীতি বা রাশিবিদ্যার তত্ত্ব ভিন্ন কথা বলতে পারে। নমুনা বা স্যাম্পল যথাযথ নয়, এমনও বলতে পারে। তবু ভাবতে ভাল লাগে, কম মানুষের মধ্যে হলেও ‘পুজো পুজো গন্ধ’টা থেকেই যাবে, তার উপকরণগুলি নিয়ে মাতামাতিও হারিয়ে যাবে না। পুজোবার্ষিকীও থেকে যাবে। সাহিত্যের নানা উত্থানপতন, ভাল বাংলা বই খারাপ বাংলা বই-এর তর্ককে উড়িয়ে দিয়ে, পুজোর গন্ধ আনতে এবং ছড়াতেই থেকে যাবে পূজাবার্ষিকীরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement