সত্যজিৎ রায় সত্ত্বেও, ছবির দর্শক হিসেবে আজও আমাদের প্রধান অভ্যাস শুধু একটি গল্পকেই চোখের সামনে ঘটে যেতে দেখা।” শঙ্খ ঘোষের এ মন্তব্য সত্যজিতের পথের পাঁচালী মুক্তির (১৯৫৫) ২৫ বছর পরে। তাঁর মনে হয়েছিল যে, তখনও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি আমাদের পুরনো অভ্যেস, আমাদের দৃষ্টিশক্তিহীন গল্পনির্ভরতার মন। পথের পাঁচালী মুক্তির ৬৫ বছর পরে এখনও প্রাসঙ্গিক কবির কথাগুলি। সাহসী পরিচালকের অভাব নেই এ দেশে, তবু আমাদের মন বুঁদ হতে চায় সিনেমার সেই সব ঘটনা আর সংলাপের বহুলতায়, যা পূর্বতন দৃশ্যরূপেরই সম্প্রসারণ মাত্র। যদি বা দৃশ্য-শব্দ-নিঃশব্দের পারস্পরিকতায় ফিল্মে তৈরি হয় অনুপম কিছু মুহূর্ত, তার পরেই তার ঘটনাবাহী ব্যাখ্যা বা কথার বিস্তারে অস্পষ্ট হতে থাকে ফিল্মটির ধার, পরিচালক আর সাহস বজায় রাখতে পারেন না, আমাদের রুচিই পাঁচিল বানিয়ে তোলে তাঁর সামনে।
ওই পাঁচিল ভাঙতে পেরেছিলেন বলেই সত্যজিৎ রায় ভারতীয় সিনেমার পুরোধা। আদুর গোপালকৃষ্ণন বা গিরিশ কাসারাভাল্লির কাছে যত বার প্রশ্ন রেখেছি ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস কোথা থেকে শুরু করতে হবে, তাঁরা উত্তর দিয়েছেন: পথের পাঁচালী থেকে। পঞ্চাশের দশকে বেশ শক্তই ছিল পাঁচিল ভাঙা। চলচ্চিত্র যে একটা ‘সিরিয়াস আর্ট’ হতে পারে, তার যে একটা নির্দিষ্ট শিল্পরূপ থাকতে পারে, সমাজ সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধিৎসা থেকে মানবমনের সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্ব যে তাতে ঠাঁই পেতে পারে, তখন ‘এটা কেউ মানতেনই না’, লিখেছেন সত্যজিৎ।
বরাবরই তিনি বলেছেন, নিজের ছবিতে করেও দেখিয়েছেন, পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের স্থাপত্য (তার নাটকীয়তা বা সময়ের প্রতি দায়বদ্ধতা) কী ভাবে সিনেমার সংগঠনের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে যায়, দু’টি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সিনেমার সাঙ্গীতিক কাঠামোর এই জটিল সমগ্রতা যদি কোনও ছবি-করিয়ে অনুভব করতে না পারেন, তাঁর পক্ষে শিল্পসৃষ্টি অসম্ভব। এই অনুভবের অভাব থাকলে ভাল ফিল্ম বোঝাও দর্শকের পক্ষে অসম্ভব। ভারতীয় সিনেমার এই সঙ্কট নিয়ে সতত সরব তিনি, কারণ কখনও ভোলেননি পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় পথের পাঁচালী-র প্রস্তুতিপর্বে কত শক্ত পাঁচিল তাঁকে ভাঙতে হয়েছিল। ১৯৭৬-এ লিখলেন: “আমাদের বাঙালিদের, শিল্পগ্রহণের মনটা বোধহয় মূলত সাহিত্যিক মন। অর্থাৎ সাংগীতিক মন নয় বা চিত্রগত মন নয়।” (‘ছবি’ ও ‘গান’, শারদীয় পরিচয়, ১৩৮৩)।
প্রবন্ধটির শেষ অনুচ্ছেদে জানিয়েছিলেন, দৈনন্দিন বাস্তবকে শিল্পে উন্নীত করাই ফিল্মের কাজ, কিন্তু সেখানে সাহিত্যের কাঠামো প্রধান হয়ে ওঠে না, দৈনন্দিনের অন্তরতর ছন্দকে বিন্যাসের নেপথ্যে বহমান রাখতে হলে সাঙ্গীতিক কাঠামোটিই আবশ্যিক হয়ে ওঠে ফিল্মে। মুশকিল হল, দর্শক হিসেবে আমাদের মধ্যবিত্ত মন স্বরচিত সংস্কার আর প্রচলিত ভাবনায় নিজেকে লুকিয়ে রাখতেই ভালবাসে, পাছে নিজেকে দেখে ফেলতে হয় ফিল্মে, ঘটে যায় মূল্যবোধের বিপর্যয়, তাই সত্যের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য মনে হয় ফিল্মের বানিয়ে-তোলা গল্পকে। এ ভাবেই আমরা অজানতে মনের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিকতার পাঁচিল তৈরি করি, শঙ্খ ঘোষ তা খেয়াল করিয়ে দেন তাঁর পথের পাঁচালী পর্বের স্মৃতি থেকে: “ফিল্মের মধ্যে কথাবহুল গল্প শুনবার একটা সাহিত্যরীতিতে এতই অভ্যস্ত ছিলেন তাঁরা যে ও-ছবিতে অনেক দর্শকই দেখেছিলেন গল্পের মস্ত অভাব... ‘অপরাজিত’-তে ধাক্কাটা ছিল আরো একটু বেশি।” (ইশারা অবিরত, প্যাপিরাস)।
আসলে কবিতা, নাটক, উপন্যাস, চিত্র, ভাস্কর্য, সঙ্গীত, নৃত্য, অভিনয়, এই সব শিল্পরূপের সঙ্গে আমাদের পরিচয় বহু দিনের, তুলনায় ফিল্মের সঙ্গে পরিচয় নতুন, স্বাধীনতার কিছু কাল আগে— ফলে ফিল্মের যন্ত্রনির্ভরতার সঙ্গে হয়তো এক ধরনের আত্মীয়তা তৈরি হয়েছিল আমাদের, কিন্তু আঙ্গিক রপ্ত হয়নি, সত্যজিতের আগমনের আগে পর্যন্ত তা অধরাই ছিল। শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্র যে নিজ বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর, আর তার গুণাগুণ বিচারে যে এক বিশেষ ধরনের সমঝদারির প্রয়োজন, এই ধারণা দু’টি দর্শকমনে সঞ্চারিত করার জন্যে ফিল্ম করার পাশাপাশি লাগাতার লিখেও গিয়েছেন সত্যজিৎ।
পথের পাঁচালী-র আগে ‘সমাজ-সচেতন’ ছবি অনেক হয়েছে ভারতীয় সিনেমায়, কিন্তু সে সব ছবির সমাজচিন্তা এতই উচ্চকিত যে, তা আমাদের জীবনযাপনের অভ্যস্ততা থেকে উচ্চারিত হত না, আমাদের অকিঞ্চিৎকর দিনযাপনের অচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠত না। এরই বিপ্রতীপে সত্যজিৎ তাঁর প্রথম ছবিতে বাংলার এমন এক পরিবারকে ছবিতে গাঁথলেন, যে পরিবারটি নিজের বসতবাড়িতেই উদ্বাস্তুর মতো বেঁচে থাকে, শেষে দারিদ্রের চাপে সেই বাড়িও ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে যায়। এ এমন এক জীবন নিয়ে ফিল্ম যেখানে জীবিকা নেই, খাওয়া-পরা নেই, বেঁচে থাকা যেন কেবল মরে যাওয়ার জন্যেই।
সত্যজিৎ সেই ভারতীয়, যিনি প্রথম আমাদের সিনেমার শিল্পরূপ চিনিয়েছিলেন, সিনেমার পাখসাটে আমাদের দেশ খুঁজতে শিখিয়েছিলেন।