তল্লাশি: অস্থায়ী চেক পয়েন্টে এক যুবক ও সেনা প্রহরী। ২০ অক্টোবর, শ্রীনগর। পিটিআই।
অনেক দিন পরে সম্প্রতি বেশ কয়েক জন মারা গেলেন কাশ্মীরে। সাধারণ মানুষ থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, জঙ্গিও বেশ কয়েক জন। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পরে উপত্যকা গত দু’বছর বেশ শান্ত ছিল। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ২০ জন পুলিশকর্মী নিহত হন বলে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের ইনস্পেক্টর জেনারেল বিজয় কুমার জানিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রতিবেদন বলছে, গত পাঁচ বছরে (২০১৬-২০) পুলিশকর্মী হত্যার বার্ষিক গড় ৭৯। পরিস্থিতির, অতএব, খুব একটা অবনতি ২০১৯-এর অগস্টে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পরে হয়নি। অক্টোবরের মাঝামাঝি কিন্তু হিংসা ও মৃত্যুর হার হঠাৎ বেড়ে গেল। গত ১১ অক্টোবর এক দিনে জম্মু-কাশ্মীরের রাজৌরী সেক্টরে এক আধিকারিক-সহ পাঁচ সেনা সদস্যের মৃত্যু হল। নিরাপত্তা কর্মী, জঙ্গি থেকে সাধারণ মানুষের নিধন— অক্টোবর থেকে লাফিয়ে বেড়ে গেল। এই আশঙ্কাই করছিলেন জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের প্রাক্তন মহা-নির্দেশক কুলদীপ খোডা ও বিজয় কুমার। উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো একটা ঘটনা কাশ্মীরে তাঁরা লক্ষ করছিলেন। পুলিশের সাধারণ কর্মীরা প্রকাশ্যে খুন হচ্ছেন, যাঁরা কেন্দ্রীয় আধা-সামরিক বা সেনাবাহিনীর মতো সুরক্ষা পান না। অথচ, তাঁদের মানুষের মধ্যে থেকে যানবাহন পরিচালনার মতো রুটিন কাজ, বা গ্রামের ভিতরে ঢুকে গোয়েন্দা-তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। তাঁদের উপরে হামলা করলে তাঁদের মনোবল ভেঙে যায়, সুবিধা হয় জঙ্গি সংগঠনের— মত খোডার।
পরিসংখ্যান দিয়ে হয়তো পরিস্থিতি এখনও বিরাট উদ্বেগের নয়। প্রশাসন তবু উদ্বিগ্ন। কারণ, আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সেনা প্রত্যাহার। আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েট ইউনিয়ন সেনা সরানোর পরে ১৯৯০ থেকে ’৯৪-এর মধ্যে, খোডার কথায়, “পরিস্থিতি সম্পূর্ণ হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল।” সে সময়ে ভারতীয় গোয়েন্দাদের উদ্ধৃত করে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, “অন্তত ২০০ বিদ্রোহী জম্মু-কাশ্মীরে ঢুকে পড়েছে, ৪০০ বিদেশি যুদ্ধবাজও উপত্যকায় রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।” স্থানীয় দুই জঙ্গি সংগঠন আল বার্ক এবং হরকত-উল-মুজাহিদিন’এর সঙ্গে নব্বই-দশকে হাত মিলিয়ে ছিল আফগান যুদ্ধবাজরা। বর্তমানে সক্রিয় রয়েছে লস্কর-ই-তইবা (এলইটি), জইশ-ই-মহম্মদ (জেইএম) ও পুলিশের মতে, দুই সংগঠনের শাখা-গোষ্ঠী।
আফগানিস্তানে ২০-২৫ বছর লড়াই করা সুদক্ষ গেরিলা কমান্ডার যদি এলইটি বা জেইএম-এর পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করে, বিষয়টা ভারতের পক্ষে সুখের হয় না। এই কারণেই দিল্লি সেনা প্রত্যাহার নিয়ে অসন্তুষ্ট। আফগানিস্তানের ইসলামি আমিরশাহির উপরে পাকিস্তানের আংশিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। যুদ্ধবাজদের পাকিস্তানের ভিতর দিয়ে কাশ্মীর সীমান্তে এনে গন্ডগোল পাকানো খুব কঠিন কাজ নয়। জম্মুর রাজৌরী-পুঞ্চ সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশের প্রবণতা এবং এনকাউন্টারে মৃত্যু, দুই-ই সম্প্রতি বেড়েছে। “২০০৫-০৬ থেকে অঞ্চলটি শান্ত ছিল”, বক্তব্য খোডার। ২০০৮-এ ভারতের সেনাবাহিনী এই লেখককে পুঞ্চে নিয়ন্ত্রণরেখার ভিতরে ঢুকে বিভিন্ন গ্রাম পরিদর্শনের অনুমতিও দিয়েছিল, অবস্থা এতই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। দেড় দশক বাদে আবার সংঘাত এই সেক্টরেই শুরু হয়েছে। তবে ’৯০-এর অবস্থা আর ২০২১-এর পরিস্থিতি আলাদা। সে সময়ে সীমান্ত খোলা ছিল। অনেকেই পাকিস্তানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসতে পেরেছিল। এখন পাহাড়ের ভিতর দিয়ে ভারতে ঢোকা অসম্ভব না হলেও কঠিন। কাশ্মীরে যে পরিমাণে বিভিন্ন গোত্রের নিরাপত্তাকর্মী ও তথ্য সংগ্রহের নেটওয়ার্ক গত ৩০ বছরে গড়ে উঠেছে, তা এড়িয়ে গোপনে কাজ করা অসম্ভব। ফলে খোডা মনে করেন, বিরাট কোনও সুবিধা পাকিস্তান পাবে না। “শীতের পরে নিয়ন্ত্রণরেখায় অনুপ্রবেশের চেষ্টা বাড়তে পারে। তবে তা নিয়ন্ত্রণ করার মতো পরিকাঠামো এখন ভারতের আছে।”
কাশ্মীরে জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রভাব বাড়ছে কি না, তা বোঝার উপায় হল নানা অঞ্চলের যুবকেরা বিভিন্ন গোষ্ঠীতে নাম লেখাচ্ছে কি না, তা খুঁজে বার করা। বিজয় কুমার বললেন, এ বছর জঙ্গিগোষ্ঠীতে ছেলেরা তেমন যোগ দেয়নি। গত বছর যেখানে ১৬৭ জন যোগ দিয়েছিল, সেখানে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সংখ্যা ৮৮। বর্তমানে উপত্যকায় মোট সন্ত্রাসবাদীর সংখ্যা ১৯০। এদের ২৫ শতাংশ জঙ্গিগোষ্ঠীতে যোগ দেওয়ার এক থেকে তিন মাসের মধ্যে মারা যায়। ফলে আফগানিস্তান নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকলেও, কাশ্মীরে জঙ্গি তৎপরতা বাড়ছে না, বলছে প্রশাসন।
তা হলে সঙ্কট কিসের? সম্প্রতি জম্মু-কাশ্মীর পর্যটন বিভাগ কলকাতায় এসেছিল— পর্যটক টানতে। তারা জানাল, ভূস্বর্গে পর্যটকদের কোনও ঝুঁকি নেই। এই প্রচার করতে হচ্ছে, কারণ ঝুঁকি আছে। সংবিধানের দু’টি ধারা ৩৭০ এবং ৩৫এ তুলে দিয়ে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খারিজ করে দেওয়ার দু’বছর পরেও সেখানে অবস্থা স্বাভাবিক হয়নি।
নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে হামলা ঠেকাতে নিয়মিত বাঙ্কারের সংখ্যা বাড়াতে হচ্ছে, আধাসেনাও সরানো যাচ্ছে না। সেপ্টেম্বরে পুলিশকর্মীরা নিহত হওয়ার পরে, অক্টোবরের গোড়ায় অন্তত তিন জন সাধারণ নাগরিক নিহত হয়েছেন। ২০১৯-এ রাজ্য পুনর্গঠন আইন এনে উপত্যকায় বহিরাগতদের জমি-বাড়ি কেনার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। দু’বছরে মাত্র দু’জন অকাশ্মীরি সম্পত্তি কিনেছেন। আর, কাশ্মীর ছেড়ে যাওয়া ৫২০ জন প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় রাজ্যে ফিরে কাজের সুযোগ গ্রহণ করেছেন। সংসদে এই তথ্য দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জমি-বাড়ি না কেনা, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ফিরতে না চাওয়া, এর মূলে রয়েছে এক অজানা আতঙ্ক। এক ‘অবর্ণনীয় নীরবতা’ এই আতঙ্ককে বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করলেন জম্মুর বাসিন্দা তথা দিল্লির প্রবীণ সাংবাদিক পুষ্প শরাফ। জানালেন, মানুষ একেবারেই কথাবার্তা বলছে না। বিষয়টা চিন্তার। “বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হুরিয়ত কনফারেন্সের সৈয়দ গিলানির মৃতদেহ ভোর রাতে প্রায় লুকিয়ে নিয়ে গিয়ে কবর দেওয়া হল। প্রশাসন গন্ডগোলের আশঙ্কা করছিল। এ সবই আশঙ্কা বাড়ায়।” মূল স্রোতের নেতা-নেত্রীরা অবশ্য কথাবার্তা বলছেন। এটা ভাল লক্ষণ, মত শরাফের।
কোনও ঘটনার পরে সাধারণত দু’-তিন বছর কাশ্মীর একেবারে চুপ করে থাকে, তার পরে হঠাৎ ক্ষোভে ফেটে পড়ে— বছর দশেক আগে বলেছিলেন ভারতের বিদেশ বিষয়ক গোয়েন্দা শাখার এক সময়ের প্রধান এ এস দুলত। এই পর্যবেক্ষণও প্রশাসনের চিন্তার কারণ।
সর্বত্র নানা ঝুঁকি নিয়ে ‘কনফ্লিক্ট জ়োন’-এ প্রতিষ্ঠানবিরোধী খবর ছাপায় স্থানীয় পত্রিকা। তার পরে তা বেরোয় রাজধানীকেন্দ্রিক বড় সংবাদপত্রে। এর পরে লোকলস্কর নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। কিন্তু খবরটা স্থানীয় কাগজই প্রথমে ছাপে। কাশ্মীরও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু, খবর বলতে যা বোঝায়, তা কাশ্মীরে বেরোনো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন পাতার পর পাতা কাশ্মীরের গভর্নর জেনারেলের ছবি ও প্রতিবেদন বেরোয়। দিল্লিকেন্দ্রিক সংবাদপত্র স্পর্শকাতর প্রতিবেদন আর প্রকাশ করে না, আন্তর্জাতিক মাধ্যমে অধিকাংশ সময়ে কাশ্মীরের গুরুত্ব থাকে না। ফলে, মানবাধিকার লঙ্ঘন বা দুর্নীতির দৈনন্দিনের খবর বেরোনোর কোনও সম্ভাবনাই নেই, মোটামুটি ভাবে এমনই বক্তব্য কাশ্মীরের প্রায় সব সাংবাদিকের।
এ ছাড়াও, সাংবাদিকদের অনেককে নিয়মিত থানায় হাজিরা দিতে হয়, সময়ে-অসময়ে বাড়িতে তল্লাশিও চলে। অনেকের ল্যাপটপ, মোবাইলও নিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে তাঁদের বন্ধুরা জানালেন। সমাজমাধ্যমে লেখালিখি করতেন যাঁরা, অবস্থা দেখে তাঁরাও চুপ। “কয়েকটি ছেলেমেয়ে অবশ্য টাকাপয়সা ছাড়াই বিভিন্ন পোর্টালে লেখে। সম্ভবত, এদের মাথা খারাপ।”— হাসতে হাসতেই বললেন কাশ্মীরের এক অভিজ্ঞ সাংবাদিক।
সংবাদমাধ্যমের উপরে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে অভিযোগ অস্বীকার করে বিজয় কুমার বললেন, সন্ত্রাসবাদে যুক্ত থাকার অভিযোগে কিছু সাংবাদিককে জেরা ও গ্রেফতার করা হয়েছে। “তবে পুলিশ ও সাংবাদিকের সম্পর্ক বেশ ভাল।”
দু’বছর আগের গ্রীষ্মে কাশ্মীরের সাংবিধানিক পরিবর্তন সূচিত হওয়ার সময়ে উপত্যকা নিয়ে দুশ্চিন্তা পাকাপাকি ভাবে কেটে যাওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা এখন কল্পগল্প বলেই মনে হয়। সেই সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কাশ্মীর সফর করে জম্মু-কাশ্মীরের মর্যাদা আংশিক ফেরানোরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে, প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ‘ডিলিমিটেশন’-উত্তর পর্যায়ে, নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে। কাশ্মীরে বিধানসভা নির্বাচন দ্রুত শেষ করার জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের উপরে চাপ রয়েছে। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক পটভূমির দ্রুত পরিবর্তন সামলে কাশ্মীরে ভারত নির্বাচন করাতে পারে কি না, দেখা যাক।