Kolkata Derby

নারান ও টোলুবাবু

সাম্প্রদায়িক গোলমালের দিনে আমরা দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিপদে পরস্পরের পাশে থাকার কথা ভুলে বসি। তেমনই ফুটবল-যুদ্ধের আগে-পরে সমাজমাধ্যমের কদর্যতায় চাপা পড়ে যায় কিছু আশ্চর্য বন্ধুতার আখ্যান।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০২৪ ০৮:০০
Share:

যুব ভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগানের ম্যাচ। কলকাতা লিগ।

এগারো সালের সেই ঐতিহাসিক শিল্ড ফাইনালের লোকগাথা নিয়েও মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গলে তীব্র পা-টানাটানি চালু রয়েছে। ব্রিটিশ মিলিটারি টিমের বিরুদ্ধে খালি পায়ে খেলা এগারো জন সবুজ-মেরুন জার্সিধারীর কৃতিত্বে ভাগ বসাতে কট্টর লাল-হলুদরা মনে করিয়ে দেন, মোহনবাগানের সেই অমর একাদশেও বাঙাল খেলোয়াড়েরাই দলে ভারী ছিলেন।

Advertisement

এর একটা জবাব আছে মোহনবাগানিদের আস্তিনেও: তা হলে তোদের ক্লাবের গর্বের পঞ্চপাণ্ডব আপ্পারাও, ধনরাজ, সালে, ভেঙ্কটেশ, আমেদও সেই পদ্মা বা মেঘনা পারের দ্যাশ থেকে এসেছিল বুঝি! নিতান্তই ছেলেমানুষি সব ঝগড়া, কিন্তু তার ভিতরেই আমাদের পরিচিতি বা আত্মপরিচয়ের ঘোলাটে অবয়ব প্রকট হয়, এক সুতোয় জড়িয়ে থাকা আরও টুকরো টুকরো আত্মপরিচয় ফুটে ওঠে। এগারোর বীর যোদ্ধারা অনেকেই ব্রিটিশ সরকারের বা কোনও সাহেবি কোম্পানির চাকরি করতেন। দুই ভাই শিবদাস, বিজয়দাস আদতে ফরিদপুরি, রাজেন সরকার বিক্রমপুরের, কানু রায় ঢাকাইয়া কিংবা শিল্ড ফাইনালের জয়সূচক গোলদাতা অভিলাষ ঘোষের শিকড় ময়মনসিংহে। আবার মনোমোহন মুকুজ্জে উত্তরপাড়ার, ভূতি সুকুল উত্তরপ্রদেশের, সুধীর চক্রবর্তী ছিলেন পরবর্তী কালের ধর্মযাজক, কলকাতার বাঙালি খ্রিস্টান। বাঙালিয়ানার এ হল বহুমাত্রিক রূপ। কানু রায়ের পরের প্রজন্মে অনেকে ইস্টবেঙ্গল সমর্থক ছিলেন। আর অভিলাষ ঘোষ পরে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবেরই কর্মকর্তা হন।

১৯৪০-৫০’এর দশকে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের উত্থানের দিনে আবার বিপুল সংখ্যক দেশহারা মানুষকে স্বপ্ন দেখাতেন দক্ষিণ ভারতীয় পাঁচ জন ফরোয়ার্ড, যাঁদের ভাষা, ধর্মের ফারাক নিয়ে কেউ মাথা ঘামাননি। দেশের স্বাধীনতাপর্বে সাম্প্রদায়িক গোলমালের সময়ে সালে আর আপ্পারাওকে নিয়ে একটা দুর্দান্ত গল্প ময়দান পরিমণ্ডলে অনেকেরই মুখস্থ ছিল। ঠিক যেমন দক্ষিণ কলকাতায় দেবব্রত বিশ্বাস কলিম শরাফিকে নিজের বাড়িতে লুকিয়ে হিন্দু পাড়ায় দুর্বৃত্তদের থেকে রক্ষা করেন, তেমনই মুসলিম সালেও নাকি হিন্দু আপ্পারাওকে বাঁচিয়েছিলেন। ওই দু’জনকে ইস্টবেঙ্গল রেখেছিল কলুটোলার এক ডেরায়। দুর্বৃত্তেরা খবর পেয়ে হানা দেয় সেখানে। শোনা যায়, আপ্পারাওকে খাটের তলায় লুকিয়ে থাকতে বলে সালে-ই তাদের মুখোমুখি হন। বার বার বুঝিয়ে বলেন, অমুসলিম কেউ ওখানে নেই এবং নিরাবরণ হয়ে নিজের মুসলমানত্বের জলজ্যান্ত প্রমাণ দিয়ে দুষ্কৃতীদের নিরস্ত করেন।

Advertisement

১৯৪৬-৪৭’এর অশান্ত কলকাতায় শান্তিরক্ষায় গান্ধী-অনুগামী কংগ্রেস সেবাদলের ছেলেরা একজোট হয়ে স্লোগান দিতেন, “হিন্দু, মুসলিম ভাই, ভাই/ ভুলো মত, ভুলো মত!” কলকাতা ফুটবলের ময়দান তারই ফলিত রূপ হয়ে উঠেছিল, যার শরিক মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল। ১৯৫০-এর দশকের কলকাতা এক আশ্চর্য শহর! শিয়ালদহ স্টেশনে তখনও থিকথিক করছে সব-হারানো উদ্বাস্তুর দল। মাঠে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানকে প্রায়ই হারাচ্ছে, আমেদ খান বা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা তারকা ফুটবলার মাসুদ ফকরির গোলে। ফকরি পাকিস্তান জাতীয় দলেও খেলতেন। কিন্তু টাটকা দেশভাগের ক্ষত, হিংসার রক্তাক্ত সব স্মৃতি, এমনকি পূর্ব পাকিস্তানে তত দিনে শুরু হয়ে যাওয়া ভাষা আন্দোলন, কিছুই কখনওই তাঁর কলকাতা ময়দানের নায়ক হয়ে ওঠায় বাধা হয়নি।

তখনও মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গলকে মাচা, লোটা ইত্যাদি সম্বোধন, ঠাট্টা শুরু হয়নি। তবে দেশভাগের টাটকা ক্ষত নিয়েও কলকাতায় ইস্টবেঙ্গলের পরাজয়ে ‘হারল কারা? বাস্তুহারা’ বলে নিষ্ঠুর স্লোগান উঠত। মোহনবাগান হারলেও পাড়ায় ফুটো ঘটি ঝুলিয়ে আনন্দ করত বাঙাল জনতা। তবু তখনও মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গলকে ঘটি বা বাঙাল পরিচয়ের সীমানায় বেঁধে রাখা যেত না। নাগাল্যান্ডের টি আও মোহনবাগানে খেলেই অলিম্পিকে দেশের অধিনায়কত্ব করেন। বাঙাল চুনী আর মোহনবাগান সমার্থক হয়ে ওঠে। বেঙ্গালুরুর কেম্পিয়া, অরুময়, পঞ্জাবের জার্নেলও অনায়াসে সবুজ-মেরুনের ঘরের ছেলে হয়ে ওঠেন। একই সময়ে ইস্টবেঙ্গল মানেও তখন ফকরি, আমেদ, রামবাহাদুর বা বলরাম। শোনা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে পায়ে হেঁটে ব্রহ্মদেশ থেকে কলকাতায় এসে ইস্টবেঙ্গলের জার্সি পরেন অ্যাংলো-বার্মিজ় খেলোয়াড় ফ্রেড পাগসলে। ময়দানের মাত্র কয়েক বছরে প্রতিপক্ষের ত্রাস ছিলেন তিনি। পাগসলে বা ১৯৩০-এর দশকে অবিভক্ত ভারতের কোয়েটা থেকে আসা মোহনবাগানের ক্যাপ্টেন আব্দুল হামিদের বিষয়ে নানা ছেঁড়াখোঁড়া গল্পের টুকরো ময়দানি বাতাসে উড়ত, একদা। আজকের দিনে দেশে বিভাজনের রাজনীতির যুগ সন্ধিক্ষণে আফসোস হয়, সেই গল্পের সুতোগুলো যদি আর একটু ভাল ভাবে ছাড়ানো যেত! বাঙালির মনন নির্মাণের ইতিহাসও তা হলে আর একটু বিশদে বোঝা সম্ভব হত।

জাতি, ধর্ম, ভাষার খোপ বঙ্গজীবনে থাকলেও শহরের ফুসফুস ময়দান অবশ্যই বাঙালিকে ক্ষুদ্র আত্মপরিচয়ের বাইরে ভাবতে শিখিয়েছে। হাবিব বা শ্যাম থাপাকে অবাঙালি ভাবাটা তাই আমাদের অনেকের জন্যই কঠিন। পরে ব্রাজ়িলীয় ব্যারেটোও মোহনবাগানে মান্না, চুনী, বাবলুর গোত্রভুক্ত হয়েছেন। মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাব নিয়ে আবেগও বেশি দিন নিছকই মুসলিম পরিচয়ের ঘেরাটোপে শান্তি খোঁজেনি। ১৯৩০-এর দশকে প্রধানত অবিভক্ত ভারতের মুসলিম খেলোয়াড়দের দল ছিল মহমেডান। সেই পরিচয় তারা ছাপিয়ে গিয়েছে। আজ আইএসএল-এ খেলার উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি করা সাদা-কালো ব্রিগেডও স্বাভাবিক নিয়মে বাংলা বা দেশের সব ভাল ফুটবলারকে কাছে টানা সংস্কৃতিরই ধারক।

আইএসএল যুগের কর্পোরেট-শাসিত ভারতীয় ফুটবলে বিশ্ববাজার থেকে উঠে আসা মেঠো নায়কদেরই দাপট। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল কার্যত বাঙালি ফুটবলারবিহীন। তবে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল মাঠে নামলে তাদের বাঙালিয়ানার দু’টি থাকবন্দি ঘরানা, ঘটি ও বাঙালদের প্রতিনিধি বলে ধরা হয়। ঘটি-বাঙাল নিয়ে কয়েক দশকের ক্লিশে ঠাট্টা-ইয়ার্কির দাঁত-নখ এখনও ধারালো হচ্ছে। আর পাঁচটা দিকের মতো এ ক্ষেত্রেও সোশ্যাল মিডিয়ায় দুই শিবিরের কদর্যতার জমকালো বিজ্ঞাপন। আগ্রাসী ঘৃণা এবং অভব্য গালিগালাজ সংস্কৃতির মধ্যে ঘটি-বাঙালের ঠোকাঠুকির রসবোধ ইদানীং প্রায়ই হারিয়ে যায়। নানা বদলে ঘটিত্ব বা বাঙালত্বের অস্তিত্ব নিয়েই আজকাল প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা আমরা ভুলে যাচ্ছি, পারস্পরিক কিছু বিভিন্নতা থেকে থাকলেও তা আসলে নিজস্বতা, তার মধ্যে ছোট-বড়, উঁচু-নিচু নয়, যা আছে তা বৈচিত্রেরই উদ্‌যাপন।

ডার্বি উত্তেজনার আঁচে আজকাল মতি নন্দীর নারান উপন্যাসটির কথা বড্ড মনে পড়ে। সেও ১৯৫০-এর দশকের বাংলার গল্প। নারান দিনের এক মুহূর্তও বসে সময় নষ্ট না-করা উদ্বাস্তু ঘরের গৃহকর্তা। রাতভর কলকাতার কাগজের অফিসে নাইট ডিউটি করা পিয়ন সাত-সকালে দূরের গাঁয়ে সাইকেলে খবরের কাগজের হকারি করে। তার পরও গরুর ঘাস কাটা, বাড়তি রোজগারের জন্য ক’টা ঠোঙা বানানোর ফাঁকে মেয়েকে নামতা মুখস্থ করায়। ফাঁকতালে ঘুমোয় মোটামুটি ট্রেনে আসা-যাওয়ার সময়ে। সে ইস্টবেঙ্গল সমর্থক হয়েও খেলা দেখার সময় মোটে পায় না। তবে দূর পাল্লার দৌড়ে এমিল জ়াটোপেকের তিনটে অলিম্পিক সোনা জিতে অবিশ্বাস্য কীর্তির খবর কাগজে পড়ে, অকিঞ্চিৎকর জীবনে মনে মনে তাঁকেই আদর্শ মেনে নিয়েছে সে। কাগজের কুসংস্কারগ্রস্ত সাব-এডিটর টোলুবাবুর জীবনে এ সব উচ্চ চিন্তাভাবনা নেই। অফিসে ডিউটির ফাঁকে অলিম্পিকের খবরাখবর ভুলে লিগ, শিল্ড, ডুরান্ডে মোহনবাগানের ভবিষ্যৎ নিয়েই তিনি কাতর। মোহনবাগানের পরের খেলায় মঙ্গল চেয়ে রাতদিন বিচিত্র সব পয়া-অপয়ার হিসাব কষছেন। কৈশোরে পুজোসংখ্যায় পড়ার সময়ে ভাল বুঝিনি, শুধু নারান নয়, টোলুবাবুও এ কাহিনির নায়ক। সামাজিক মর্যাদার ফারাক সত্ত্বেও ভিন্ন মেরুর এই দু’জন মানুষ দু’জনের বন্ধু। জুতো কেনার সঙ্গতিহীন নারানের পায়ে পেরেক ফোটা বিপদে টোলুবাবুই সহায়সম্বল। ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ, ইনজেকশনে সেপটিকের বিপদ ঠেকিয়ে, নারানকে নতুন কেডসও কিনে দেন তিনি।সাম্প্রদায়িক গোলমালের দিনে আমরা প্রায়ই এ দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিপদে পরস্পরের পাশে থাকার কথা ভুলে বসি। ঠিক তেমনই ফুটবল-যুদ্ধের আগে-পরে সমাজমাধ্যমের কদর্যতায় চাপা পড়ে যায় কিছু আশ্চর্য বন্ধুতার আখ্যান। নারানের জীবনযুদ্ধের দৌড়ে পরিশ্রম দেখে টোলুবাবু অদ্ভুত রোমাঞ্চকর আনন্দে বিভোর। তিনি যতটুকু পারেন পড়শির পাশে থাকেন। নারানের জন্য নতুন কেডস কিনে টোলুবাবু যে মোহনবাগানের লিগ জয়েরই সুখ খুঁজে পান।

মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল জার্সিতে ঘরের ছেলে হাতেগোনা। তবু দুই দলেই কিছু নারান আর টোলুবাবু আছেন, এটুকু এখনও স্বস্তি দেয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement