কয়েক দিন আগে বারাসত থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনাগামী রুটের একটা লোকাল বাসে ভাড়া আদায় করার সময় একটা ঘটনা ঘটল। অন্য যাত্রীরা কন্ডাক্টরের দাবিমতো ভাড়া দিলেও বেঁকে বসলেন এক নিত্যযাত্রী। তিনি অনুদান বাবদ অতিরিক্ত ভাড়া দিতে নারাজ, কন্ডাক্টরও নাছোড়। যাত্রী ভদ্রলোক সরকারি নির্দেশিকার কথা তুললেও কন্ডাক্টর মানতে নারাজ। উল্টে হুমকি দিলেন, তিনি ভবিষ্যতে ওই যাত্রীকে বাসে উঠতে দেবেন না। বাসের অন্য যাত্রীরা নীরব দর্শক। ব্যাপারটা যখন প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে, ঠিক তখনই মধ্যস্থতায় এগিয়ে এলেন দু’জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। তাঁরাই যুযুধান দুই পক্ষকে বুঝিয়েসুজিয়ে শান্ত করলেন।
বাসভাড়া নিয়ে যাত্রী এবং কন্ডাক্টরদের মধ্যে বিরোধ এবং বচসা এ রাজ্যে কিছু নতুন ঘটনা নয়। গত বছর লকডাউন উঠে যাওয়ার পর এ রাজ্যে ৪ মে, ২০২০ থেকে নতুন করে বাস পরিষেবা শুরু হল। তখন পঞ্চাশ শতাংশ যাত্রী পরিবহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, যাতে কোভিড পরিস্থিতিতে শারীরিক দূরত্ব বজায় থাকে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ঘটেছিল ঠিক বিপরীত ঘটনা। বাসে উপচে পড়া ভিড় হওয়া সত্ত্বেও বাস মালিক সংগঠনগুলি ক্রমবর্ধমান জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিকে তুলে ধরে বারংবার ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছিল। সরকার ভাড়া না বাড়ানোর সিদ্ধান্তে অবিচল থাকায় প্রাথমিক ভাবে বাস মালিক সংগঠনগুলি বাস চালাতে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ এবং বাস পরিষেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের দুর্দশার কথা বিবেচনা করে (এবং অবশ্যই সরকারি চাপে) কিছু কিছু বাস রাস্তায় নামতে শুরু করে। তখন থেকেই বেসরকারি বাসের বিরুদ্ধে যাত্রীদের থেকে বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ উঠতে শুরু করে।
এ বছর বিধানসভা নির্বাচন মিটে যাওয়ার পর কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে রাজ্যের কোভিড পরিস্থিতির ক্রমাবনতির কারণে ১৬ মে, ২০২১ থেকে নতুন করে আংশিক লকডাউন কার্যকর হওয়ার সময় ফের গণপরিবহণ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। পরে ২৭ মে, ২০২১ পুনরায় সীমিত সংখ্যক যাত্রী নিয়ে বেসরকারি বাস চালানোর ছাড়পত্র ঘোষণার পর থেকেই ভাড়া বাড়ানো নিয়ে বাসমালিক সংগঠনগুলির সঙ্গে সরকারের দড়ি টানাটানি চলছে। তবে রাজ্য সরকার এই কোভিড পরিস্থিতিতে মানুষের উপর যে বাড়তি বাসভাড়া চাপানোর পক্ষপাতী নয়, তাও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে। ফলে, প্রথম দিকে কিছু কিছু বাস মালিক ভাড়া বিষয়ে যাত্রীদের কাছে সহানুভূতির আবেদন করলেও অধিকাংশ রুটে ‘অনুদান’-এর নামে বাড়তি ভাড়া আদায় দস্তুর হয়ে উঠেছে।
সরকার অবশ্য বরাবরই যাত্রীদের কাছে বাড়তি ভাড়া না দেওয়ার আবেদন করে আসছে। এমনকি বাড়তি ভাড়া নিলে সংশ্লিষ্ট কন্ডাক্টরের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করার পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অনুদানের নামে কন্ডাক্টরের মর্জিমতো ভাড়া না দিলে যাত্রীদের কী ধরনের হেনস্থার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তা ভুক্তভোগীমাত্রেই জানেন। অথচ, তাঁরা যে সরকারের পরামর্শমতো এ ব্যাপারে পুলিশের দ্বারস্থ হবেন, তারও কিছু বাস্তবসম্মত অসুবিধে রয়েছে। সবচেয়ে বড় মুশকিল হল, যে হেতু লোকাল বাসের টিকিটে যাত্রী কোথা থেকে উঠলেন এবং কোথায় নামলেন, বা কত দূরত্বের জন্যে কত ভাড়া নেওয়া হল, তা উল্লেখ করার ব্যবস্থা নেই, তাই শুধুমাত্র টাকার অঙ্ক লেখা টিকিট দেখিয়ে বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণ করা শক্ত।
এ দিকে সীমিত ক্ষেত্রে কোভিড নিয়ন্ত্রণ জারি থাকলেও অফিস থেকে দোকান-বাজার সবই খুলে গিয়েছে। কোভিডের কারণে দীর্ঘ দিন ঘরবন্দি এবং জীবিকা হারানো মানুষকে নিতান্ত পেটের দায়েই বাইরে বেরোতে হচ্ছে। অথচ, লোকাল ট্রেন এখনও বন্ধ, সরকারি বাসও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাই পথে বেরোনো অসহায় যাত্রীদের একমাত্র ভরসা ভিড়ে-ঠাসা লোকাল বাস।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, ২০১৮ সালে লোকাল বাসের ভাড়া শেষ বারের মতো পুনর্নির্ধারণ করার পর থেকে পেট্রল এবং ডিজ়েলের দাম প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। ২০১৮ সালে এ রাজ্যে ডিজ়েলের সর্বোচ্চ দাম ছিল লিটার প্রতি ৭১.০৬ টাকা। অথচ, বাড়তে বাড়তে সেই ডিজ়েলের দাম ২০ অগস্ট, ২০২১-এ ৯২.৩৭ টাকায় পৌঁছেছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় কর ৩১.৮০ টাকা এবং রাজ্যের কর ১৩.০৮ টাকা, অর্থাৎ প্রতি লিটার ডিজ়েলে শুধু কর বাবদ এক জন গ্রাহককে দিতে হচ্ছে ৪৪.৮৮ টাকা।
রাজ্য সরকার অবশ্য গত ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ থেকে পেট্রল এবং ডিজ়েলের উপর লিটার প্রতি ১ টাকা করে কর ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া, গণপরিবহণের ক্ষেত্রে দেয় পথকরও মকুব করা হয়েছে, যার বার্ষিক পরিমাণ প্রায় ১২০ কোটি টাকা। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাসের ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত আশ্চর্য রকম ভাবে নীরব। তাই বাস মালিক সংগঠনগুলির দাবি, জ্বালানি তেল এবং যন্ত্রাংশের সার্বিক মূল্যবৃদ্ধিজনিত ব্যয়বৃদ্ধির নিরিখে এই ছাড় সিন্ধুতে বিন্দুসম।
এই অবস্থায়, বাস মালিকদের ভাড়া বৃদ্ধির দাবিকে একেবারে অযৌক্তিক বলা যায় না। তবে মুদ্রার একটা উল্টো পিঠও রয়েছে। বেসরকারি বাসের ক্ষেত্রে যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি চিরকালই অবহেলিত। প্রথমত, বেশির ভাগ লোকাল রুটের বাসে যাত্রীদের বসার সিটগুলো নির্ধারিত মাপের চাইতে ছোট, তদুপরি দু’সারি সিটের মধ্যবর্তী যে ব্যবধান থাকার কথা, অধিকাংশ বাসেই তা সঙ্কুচিত। দ্বিতীয়ত, সরকার-নির্দিষ্ট ভাড়ার তালিকা পাঠযোগ্য মাপের অক্ষরে বাসের একাধিক স্থানে টাঙিয়ে রাখার নির্দেশিকা থাকলেও অধিকাংশ বাসে সেই তালিকা দেখতে পাওয়া যায় না। ফলে কোন দূরত্বের জন্য কত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, নিত্যযাত্রী ব্যতীত কারও পক্ষে তা জানা সম্ভব হয় না। তৃতীয়ত, মহিলাদের জন্যে সংরক্ষিত আসনের বিন্যাস বিভিন্ন বাসে বিভিন্ন রকম। ফলে বাসে উঠে অনেক সময় যাত্রীরা কোন দিকে এগোবেন বুঝতে পারেন না। আগে বয়স্ক এবং অশক্ত যাত্রীদের ওঠানামার সময় ‘খালাসি’ নামক এক শ্রেণির কর্মীরা সাহায্য করতেন। এখন ব্যয় সঙ্কোচের স্বার্থে ‘খালাসি’ প্রথার অবলুপ্তি ঘটায় সেই সাহায্যও অমিল। চতুর্থত, যত্রতত্র বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো এবং একাধিক চলমান বাসের মধ্যে রেষারেষি বেসরকারি বাসের অত্যন্ত পুরনো রোগ। এর ফলে যাত্রীদের প্রাণ সংশয় কোনও বিরল ঘটনা নয়। এ ছাড়া, বাসের পা-দানির উচ্চতা, ইচ্ছামতো ট্রিপ বাতিল করা-সহ পরিষেবায় ঘাটতির যে অজস্র অভিযোগ রয়েছে, সেগুলোও ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। সুতরাং, ভাড়া বাড়ানোর দাবির পাশাপাশি যাত্রী-স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টিও সমান গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত।
অতি সম্প্রতি রাজ্য সরকার অবশ্য ২০২০ সালের এক বৈঠকের কথা উল্লেখ করে সমস্ত বাস মালিক সংগঠনগুলিকে পুনরায় বাড়তি ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করার পাশাপাশি প্রয়োজনে পারমিট বাতিলের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের হুঁশিয়ারিও দিয়েছে। তবে, নিয়মিত সরকারি নজরদারির সঙ্গে জ্বালানি তেলে মূল্যে ভর্তুকি বা ভাড়ার পুনর্বিন্যাস ব্যতিরেকে এই অব্যবস্থা দূর করা সম্ভব নয়। সুষ্ঠু ভাবে যাত্রী পরিবহণের সঙ্গে দৈনন্দিন যাত্রী-কন্ডাক্টর দ্বৈরথ নিরসন নিশ্চিত করতে তাই এখনই সরকারি পদক্ষেপ জরুরি।