ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কতখানি ভাল থাকবে, সেটা আমাদের উপর নির্ভর করছে বহুলাংশে। আমরা যদি আন্তঃপ্রজন্ম সমদর্শিতার নীতিটিকে সফল ভাবে মেনে চলি, তা হলে আমাদের সন্তানরা অন্তত আমাদের মতোই ভাল থাকবে। আমরা যদি উইল বা ইচ্ছাপত্র করে যাই, তা হলে তারা আমাদের চেয়ে ভাল থাকবে। কিন্তু, আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে যা পেয়েছি, তা যদি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা না ভেবেই সবটা ভোগ করে ফেলি, তা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের সেই অবিমৃশ্যকারিতার ফল ভোগ করবে। এই কথাটা প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষেত্রে অক্ষরে অক্ষরে সত্য।
ভারতের জাতীয় খনিজ নীতি ২০১৯ বলে: “প্রাকৃতিক সম্পদ, এমনকি খনিজ সম্পদও একটি সামুদায়িক উত্তরাধিকার, জনগণের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রই এর ট্রাস্ট্রি বা অছি— রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের এই সামুদায়িক উত্তরাধিকারের সুফল পায়।” অর্থাৎ, বর্তমানের গ্রাস থেকে ভবিষ্যতের স্বার্থকে রক্ষা করার দায়িত্বটি সরকারের উপর ন্যস্ত। দুর্ভাগ্য, রাজনৈতিক লবির চাপ আর প্রশাসনিক দুর্নীতি— এই দুইয়ের সাঁড়াশি চাপে সরকার এই দায়িত্বটি পালনে প্রায় সর্বদাই ব্যর্থ। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, খনিজ দ্রব্যের প্রকৃত মূল্যের তুলনায় অনেক কম দামে বিক্রি করছে সরকার।
যেমন, একটি প্রকাশিত সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ২০০৪ থেকে ২০১২ পর্যন্ত আট বছরে, খনিজ নিষ্কাশনের খরচ ও নিষ্কাশনকারীর জন্য যুক্তিসঙ্গত লাভের হিসাব বাদ দিয়ে, গোয়া রাজ্যটি তার খনিজ দ্রব্যগুলির মূল্যের ৯৫ শতাংশেরও বেশি লোকসান করেছে। যে কোনও সরকারি ক্ষতিই তো আসলে সাধারণ মানুষের উপর আরোপিত একটি প্রচ্ছন্ন কর। খনিজ উত্তোলনের ক্ষেত্রে সরকার ক্ষতি স্বীকার করে আসলে জনগণের টাকা পাইয়ে দিল নিষ্কাশনকারী সংস্থাকে। এবং, বিপুল ক্ষতির পরেও যে সামান্য টাকা সরকার পায়, সেটাকেই ‘আয়’ হিসাবে ধরে মহানন্দে ব্যয় করে চলে— ভবিষ্যতের জন্য পড়ে থাকে না কিছুই।
তবে, শুধু ভারত নয়, দুনিয়া জুড়েই এই নিরলস খননকার্য যে ক্রমবর্ধমান ক্ষতি করে চলেছে, তার প্রমাণ রয়েছে। যেমন, আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে, ইংল্যান্ড এবং নরওয়ে-সহ খনিজ সম্পদশালী দেশগুলির অনেক সরকারই রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের নেট মূল্য হ্রাসের সম্মুখীন হচ্ছে— দেখা যাচ্ছে, বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষিতে তাদের সরকার ক্রমশ গরিব হয়ে যাচ্ছে।
সমস্যা হল, এই ক্ষতিটির চেহারা খালি চোখে ধরা পড়ে না। বরং, মনে হতে পারে যে, একটা খনি থেকে যদি পাঁচ টাকা আয় হয়, তবে দুটো খনি থেকে দশ টাকা লাভ হবে— অতএব, যত দ্রুত প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা যায়, ততই ভাল। সাধারণ মানুষকে রাজনীতিকরা এই কথাই বোঝাবেন, অধিকাংশ মানুষ তা বুঝবেনও বটে। ফলে, পরিস্থিতি উত্তরোত্তর খারাপ হবে। এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে, যত ক্ষণ না সরকারি অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড অ্যাডভাইজ়রি বোর্ড, পাবলিক সেক্টর অ্যাকাউন্টিং এবং খনিজ সম্পদের জন্য প্রতিবেদনের মানদণ্ডে এই ত্রুটিটি সংশোধন না করা হচ্ছে, তত ক্ষণ পর্যন্ত রাজনীতিবিদ এবং ভোটাররা আরও খননের পক্ষে থাকবেন।
এই ধরনের লুটপাটের বিরুদ্ধে নৈতিক বা আইনি সুরক্ষা না থাকলে প্রতিটি টুকরো খনিজ খুঁড়ে বার করে ধরিত্রীর গর্ভ শূন্য করে ফেলা হবে। জাতি হিসেবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা অপরিহার্য। এটা আমাদের বুঝতেই হবে যে, খনিজ দ্রব্যগুলি আমাদের প্রাপ্ত উত্তরাধিকার, সরকারি রাজস্বের অফুরন্ত প্রাকৃতিক ঝর্নাধারা নয়।
স্পষ্টতই, এই মুহূর্তে দায়িত্ব হল এই চুরি, ক্ষতি, অপচয় বা অপব্যবহার বন্ধ করে আমাদের সন্তানদের উত্তরাধিকারের মূল্য বজায় রাখা। তার সহজতম পথ হল, খনিজ উত্তোলন সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা। কিন্তু, সেটা অর্থনীতির যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য হবে না। কাজেই, এই ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব দ্বিবিধ— এক, নিশ্চিত করা যে, খনিজ উত্তোলন থেকে সরকার ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে, কোনও ভাবেই ক্ষতি হচ্ছে না; এবং দুই, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই লাভের ভাগ নিশ্চিত করা। সম্পূর্ণ খনিজ বিক্রির বিক্রয়লব্ধ অর্থ একটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের তহবিলে সংরক্ষণ করা যেতে পারে, যেমন নরওয়েতে করা হয়।
জাতীয় পেনশন স্কিম কাঠামোর মাধ্যমেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের তহবিলে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট গোয়ায় লৌহ আকরিক নিষ্কাশন সংক্রান্ত এক মামলায় একটি স্থায়ী তহবিল গঠনের নির্দেশ দেয়, যে তহবিলের পরিমাণ আজ ৫০০ কোটি টাকা— এই নির্দেশ সারা পৃথিবীর বিচারব্যবস্থায় নজির হয়ে আছে। এই ধরনের একটি তহবিলের প্রকৃত আয় শুধুমাত্র নাগরিকদের লভ্যাংশ হিসাবে বিতরণ করা যেতে পারে, মালিক হিসাবে সকলের জন্য সমান ভাবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের পালাক্রমে এই লভ্যাংশ থেকে উপকৃত হবে।