চিন বৃদ্ধ হইতেছে। সৌজন্যে, পঁয়ত্রিশ বৎসর পূর্বে গৃহীত এক সন্তান নীতি এবং তাহা রূপায়ণে চিনের একান্ত নিজস্ব পথ অবলম্বন। প্রবল বলপ্রয়োগের পথ। জবরদস্তি বন্ধ্যাকরণ, ভ্রূণহত্যা, অগণিত প্রসূতি এবং শিশুর মৃত্যুর মধ্য দিয়া সরকারি লক্ষ্য পূর্ণ হইয়াছে। সত্তরের দশকের বিপুল জন্মহার নিয়ন্ত্রণে আসিয়াছে। কিন্তু আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে মাসুল গনিতে হইয়াছে বিস্তর। দেশে বয়স্কদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। সুতরাং শ্রমের জোগানে ভাটার টান। নারী-পুরুষ অনুপাতে ভয়ংকর অসামঞ্জস্য। সুতরাং, সমাজে বিবাহযোগ্যা কন্যার অভাব তীব্রতর। এ হেন পরিস্থিতিতে চিনকে ঢেঁকি গিলিতেই হইত। তাহাই হইয়াছে। এক সন্তান নীতি বাতিল হইয়া দুই সন্তান নীতি গ্রহণ করিবার পথে হাঁটিতে চলিয়াছে চিন।
অর্থাৎ, এক অ-গণতান্ত্রিক নীতির ত্রুটি সংশোধনে আর এক অ-গণতান্ত্রিক নীতির তলব। কোনও পরিবারের সদস্য সংখ্যা কত হইবে, তাহা নির্ধারণ করা সে দেশের সরকারের বিচার্য নহে। ইহাতে রাষ্ট্র-কর্তৃক ব্যক্তিস্বাধীনতা লঙ্ঘিত হইবার ষোলো আনা সুযোগ থাকে। মানবাধিকার তো বটেই। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ নিঃসন্দেহে দেশের, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির শিরঃপীড়ার কারণ। এই বর্ধিত জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণে পরিবার পরিকল্পনায় গুরুত্ব আরোপ আবশ্যিক শর্ত। কিন্তু তাহা কার্যকর করিতে সরকারি দমনমূলক কর্মসূচি কখনও কাঙ্ক্ষিত সমাধান হইতে পারে না। শিক্ষা, বিশেষত স্ত্রীশিক্ষার প্রসার, পর্যাপ্ত চিকিৎসার সুযোগ, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস করিবার প্রচেষ্টা এবং সর্বোপরি, সাধারণ সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সফল ভাবে জন্মহার নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। শিক্ষা ও সমাজকল্যাণে গুরুত্ব দিবার দীর্ঘ ঐতিহ্যই সফল ভাবে কেরলের জন্মহারকে নিয়ন্ত্রণ করিয়াছে। প্রতিবেশী বাংলাদেশও এ ক্ষেত্রে যোগ্য পথপ্রদর্শক হইতে পারে। দরিদ্র দেশটি দুই দশকে জন্মহার অর্ধেকে নামাইয়া আনিতে সক্ষম হইয়াছে। তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইল্যান্ডও এ ক্ষেত্রে বিশ্বে উজ্জ্বল উদাহরণ। কিন্তু আর্থিক দিক হইতে তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী চিন এক সন্তান আইন প্রয়োগে অমানবিকতার নজির সৃষ্টি করিয়াছে। দ্বিতীয় সন্তানকে স্বীকৃতি দিবার মধ্যে যেন সেই ঐতিহাসিক ভুলই স্বীকার করিয়া লইলেন চিনের নেতৃত্ব।
কিন্তু পঁয়ত্রিশ বৎসরে পট বদলাইয়া গিয়াছে। চিনে অতি দ্রুত গতিতে আর্থিক উন্নয়ন হইয়াছে। জীবনধারণ ও শিক্ষার ব্যয়বৃদ্ধি ঘটিয়াছে। অথচ, সরকারি আনুকূল্য ক্রমহ্রাসমান। সুতরাং, স্বাভাবিক বোধ হইতেই ছোট পরিবারের প্রতি পক্ষপাত বাড়িয়াছে। সরকারি অনুমতি পাইলেও চিনা দম্পতিগণ কি আজ আর দুই সন্তান গ্রহণে আগ্রহী? বিশেষত শহরাঞ্চলে? এই প্রশ্নে একটি পরিহাস নিহিত আছে। চিন জবরদস্তি করিয়া জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ চাহিয়াছিল। ইতিমধ্যে তাহার বিপুল আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়ন ঘটিয়াছে। তাহার ফলে আজ চাহিলেও জনসংখ্যা বাড়ানো যাইবে কি না, তাহা লইয়া সংশয় দেখা দিয়াছে। এই ইতিহাসই চিনের পার্টি-নেতাদের বলিয়া দিতেছে যে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে দমনপীড়নের প্রয়োজন নাই। তাঁহারা সে কথা শুনিবেন কি না, তাহা অবশ্য কঠিন প্রশ্ন, কারণ তাঁহাদের মস্তিষ্ক পার্টিতন্ত্রের মন্ত্রে দীক্ষিত। সেই মন্ত্র কেবল হুকুম জারি করিতে জানে। ‘দুই সন্তান’-এর নীতি ব্যর্থ হইলে যথেষ্ট সন্তান উৎপাদনের তাগিদে হয়তো তাঁহারা অতঃপর হুকুম দিবেন: প্রত্যেক দম্পতির ন্যূনতম চারটি সন্তান হওয়া চাই। নচেৎ মৃত্যু।