প্রতীকী ছবি
করোনার দাপটে মানুষ যখন ঘরবন্দি তখন যদি কেউ অসুস্থ হন বা দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে চিকিৎসা করানোটাই দুশ্চিন্তার। যে কোনও অপারেশনের আগে কোভিড টেস্ট এবং তার রিপোর্ট দেখে অপারেশনের আয়োজন সব মিলিয়ে খরচের বহরও অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে।
এর মধ্যেও একটা কিন্তু আছে। হু (ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন)-এর তথ্য অনুযায়ী কোভিড ১৯-এর মতো ভাইরাস সবচেয়ে বেশি ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে নাক-কান-গলা অর্থাৎ ইএনটি ও দাঁতের চিকিৎসাকেন্দ্রগুলিতে। গোটা বিশ্বজুড়েই এই ধরনের হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সবচেয়ে বেশি সাবধানতা অবলম্বনের কথা বলা হয়েছিল করোনা ছড়াতে শুরু করার সময় থেকেই। জেলাস্তরে বহু ইএনটি বা ডেন্টাল ক্লিনিক বন্ধ রেখেছিলেন চিকিৎসকেরা। জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন যে সব রোগীদের, বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল তাঁদের।
সিউড়ির সুভাষপল্লির সফিকুল ইসলাম গত তিন মাস আগে আচমকাই কানে শুনতে পাচ্ছিলেন না। লকডাউনে যেখানেই চিকিৎসার জন্য ছুটেছেন কখনও কোভিড টেস্ট কখনও চিকিৎসক নেই, কখনও আবার পিপিই কিট পরে ক্লিনিকে গেলে দূর থেকে চিকিৎসক দেখেছেন এমন নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রায় একই রকমের অভিজ্ঞতা মল্লারপুরের তরুণী পূর্ণিমা দাসেরও। ঘুমন্ত অবস্থায় কানের উপর লোহার শাবল ফেলে দিয়েছিল ছোট ছেলে। রক্তারক্তি অবস্থা। মেয়েকে নিয়ে এ ডাক্তার সে ডাক্তার বিস্তর ছুটেছেন পূর্ণিমার বাবা রবি দাস। কিন্তু নাক, কান মুখের চিকিৎসা করাতে চিকিৎসক পেলেও সমস্যা বেধেছে কেউই রোগীকে স্পর্শ করে চিকিৎসা করতে চাননি করোনা ত্রাসে। রবিবাবুর কথায়, ‘‘বহু জায়গায় তো সাদা প্লাস্টিকের পর্দার ওপার থেকে রোগীকে দেখেছেন চিকিৎসক। ভাল করে কনের ভিতরে কী হয়েছে দেখতে চাননি মেয়ের পিপিই কিট ছিল না বলে। আমরা গরীব মানুষ, রোজগার নেই। কোথায় পাব পিপিই কিট কিনে চিকিৎসা করানোর খরচ?’’
যদিও হু’এর তথ্য মেনেই ইএনটি সার্জন তুষারকান্তি ঘোষ বলেন, ‘‘কোভিড-১৯ ছড়ানো নিয়ে আমাদের এখানে চিকিৎসকদের মধ্যেও কিছু ভুল ধারণা আছে। যার শিকার হচ্ছেন রোগীরা। একটা ভাল মাস্ক, যা মুখ ও নাককে এমনভাবে ঘিরতে পারে যাতে বাইরের কোনও কণা প্রবেশ না করে সেটাই আমাদের সকলের জন্য যথেষ্ট।’’ দাঁত ও মুখের চিকিৎসক কুশলনারায়ণ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘পিপিই মোটেও সব চিকিৎসকদের জন্য প্রযোজ্য নয়। ভাল মাস্কই যথেষ্ট। সহজ পন্থা হল যাবতীয় বিষয় ফোনে জেনে নিয়ে মূল চিকিৎসা যদি হাসপাতালে বা চেম্বারে করা হয় এবং চিকিৎসক নিজে যদি তাঁর ঘরটি স্যানিটাইজ করেন নিয়ম মেনে তাহলেই অনেকটা সুরক্ষিত থাকা যায়।’’
অনেকেই আবার ভাবছেন এই পরিস্থিতিতে দাঁত বা নাক কান গলার চিকিৎসা করাতে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ কি না। এক্ষেত্রে চিকিৎসকদের অভিমত, রোগ পুষে রাখা একেবারেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বেশিরভাগ চিকিৎসকই এখন ফোনে পরামর্শ দিচ্ছেন। প্রয়োজনীয় পরামর্শ ফোনে নিলেও চিকিৎসা বিশেষত, নাক, কান, গলা বা দাঁতের ক্ষেত্রে টেলি মেডিসিন মোটেও সঠিক উপায় নয়। তাই চিকিৎসাকেন্দ্রে যেতেই হবে। শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে বহু ইএনটি বা দাঁতের চিকিৎসক আলাদা করে সময় দিচ্ছেন। অনেকেই আবার চেম্বার বা প্রাইভেট হাসপাতালের ওপিডি থেকে আসবাব সরিয়ে দূরত্ব বজায় রেখে রোগীদের বসার ব্যবস্থা করেছেন।
বেশ কিছু ডেন্টাল ও ইএনটি হাসপাতালে কোভিড রোগীদের অপারেশন ও পরবর্তী চিকিৎসা চলছে। সেখানকার চিকিৎসক ও নার্সরা ঝুঁকি নিয়েও চিকিৎসা করছেন, সেবা করছেন। সাঁইথিয়ার এক মধ্যবয়স্কা গলার ক্ষত নিয়ে ইএনটি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। অপারেশনের আগে পরীক্ষায় জানা যায় তিনি কোভিড পজ়িটিভ। তাতে অবশ্য তাঁর চিকিৎসা থেমে থাকেনি। সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরেছেন তিনি। তুষারবাবু বলেন, ‘‘এক্ষেত্রে আমরা যাঁরা ইএনটি ও দাঁতের চিকিৎসক, সবথেকে বেশি আক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকে আমাদের এবং নার্সদের। মনে রাখতে হবে, কোভিড ভাইরাস আসে মূলত থুতু থেকে। উল্টোদিকের মানুষের মুখ ও নাক দিয়ে তা প্রবেশ করতে পারে। আমরা যদি মাস্কটা ঠিকমতো ব্যবহার করি তাহলেই সুরক্ষিত থাকা যায়।’’
দাঁতের চিকিৎসক সৌমিত্র ঘোষও করোনা পরিস্থিতিতে রোগীদের ফিরিয়ে দেননি বা দূর থেকে চিকিৎসা করেননি। তাঁর কথায়, ‘‘দাঁতের চিকিৎসক হিসেবে খেয়াল রাখতে হবে, রোগী খুব সমস্যায় না পড়লে দেখাতে আসেন না। কোভিড ভীতি রোগীরও আছে, শুধু চিকিৎসকের নয়। তাই এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সচেতন হতে হবে উভয়কেই।’’ তিনি বলেন, ‘‘চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে সময় মতো চেম্বার বা হাসপাতালে আসতে হবে এই সময়। বয়স্ক ও শিশুদের জন্য আলাদা সময় রাখলেই ভাল। মাস্ক যথেষ্ট, তবে স্যানিটাইজের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।’’
পূর্ণিমা বা সফিকুলরা হয়তো সুস্থ হয়েছেন, কিন্তু জেলায় বিশেষত গ্রামের দিকে এখনও বহু রোগী আছেন যাঁরা জানেন না কোথায় গেলে চিকিৎসা মিলবে। একইভাবে চিকিৎসকদেরও অনেকে কোভিড আতঙ্কে রোগী বিমুখ এখনও। কিন্তু মাস্কই পারে আতঙ্ক দূর করতে।