শাহিনবাগে প্রতিবাদ। —ফাইল চিত্র
ডিসেম্বর ১২, ২০১৯ সাল ভারতের রাষ্ট্রপতি সাক্ষর করলেন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে। তৈরি হল নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। তার পর গঙ্গা দিয়ে বহু জল গড়িয়েছে, দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই বা বেঙ্গালুরুর মতো শহর তো বটেই দেশের বিভিন্ন ছোট শহর এবং গ্রামেও ছড়িয়েছে এই আইনের বিরুদ্ধে লড়াই।
সরকারও থেমে থাকেনি। তাঁরাও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নামিয়েছে। ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছে প্রায় ৩৫ জন মানুষ শুধুমাত্র উত্তরপ্রদেশেই। তা সত্ত্বেও আন্দোলন থেমে থাকেনি। রোজ নতুন নতুন মানুষ যোগ দিয়েছেন এই লড়াইয়ে। রোজ নতুন নতুন ফর্ম নেওয়া হয়েছে। কখনও সেগুলো খবর হয়েছে, কখনও খবর হয়নি। এর মধ্যে আন্দোলন ভাঙার নানা রকম চেষ্টা হয়েছে। কখনও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে আন্দোলনকারীদের পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, কারা মূলত এই আন্দোলন করছেন। এই আন্দোলনকে কী করে সাম্প্রদায়িক তকমা দেওয়া যায়, তার চেষ্টার কসুর করতে পিছপা হয়নি শাসক দলের নেতা-মন্ত্রী এবং ক্যাডারেরা। এর সঙ্গে নেমেছে পুলিশি নির্যাতন। জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ঢুকে অকথ্য অত্যাচার করেছে। তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে সাধারণ ছাত্রীরা। সারা দেশের ছাত্রছাত্রীরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। কলকাতা-সহ পুরো দেশে মুসলমান মহিলারা বাড়ি-ঘরদোর ছেড়ে রাতের পর রাত জেগেছেন কখনও শাহিনবাগে, কখনও আসানসোলে, আবার কখনও পার্কসার্কাসে। এ এক অভূতপুর্ব দৃশ্য। হাজার হাজার মহিলা রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদ করছেন। এ দৃশ্য দেখা যায় না। জাতীয় পতাকাকে রিক্লেইম করার এই দৃশ্য এই দেশ আগে দেখেনি। অনেক রকমের পদ্ধতি সরকারের তরফ থেকেও নেওয়া হয়েছে। কখনও মিসড কল বা কখনও পোস্টকার্ডকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সমর্থন জানানোর জন্য। কিন্তু সব কিছুরই পাল্টা উত্তর তৈরি করেছেন মানুষ। তার ভুল-ঠিক নিয়ে অন্য বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু মানুষের উদ্ধাবনী শক্তির কাছে পরাজিতই হয়েছে সরকার।
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপরে আক্রমণ হওয়ার পরবর্তী সময়ের কথা যদি খেয়াল করা যায়, তা হলে দেখা যাবে যে, দেশপ্রেমের নামে দ্বেষ ছড়ানোর কারিগরেরা তখন রাস্তায় নেমে পড়েছেন। তাঁদের হাতেও ছিল তখন জাতীয় পতাকা, কালো জামা পড়ে জাতীয় পতাকা নিয়ে মোমবাতি মিছিল দেখা গিয়েছিল প্রতিটি রাজ্যে, প্রতিটি মহল্লায়। কোনও একটি মিছিলের মুখে কিন্তু শোক ছিল না, ছিল প্রতিহিংসা নেওয়ার শপথ। ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’, ‘ভারত মাতা কি জয়’ এই স্লোগানের বিরোধিতা করার সাহস সে দিন কারও হয়নি। কোথাও কোথাও শোনা গিয়েছিল যে কাশ্মীরি মাত্রেই পাকিস্তানি, আর পাকিস্তানি মানেই সন্ত্রাসবাদী, সুতরাং তাদেরকেও এই দেশ থেকে চলে যেতে হবে।
দৃশ্য বদলে গিয়েছে। ইদানীং কালেও একই ছবি দেখা যাচ্ছে। আজও জাতীয় পতাকায় সুসজ্জিত হয়ে তরুণ-তরুণীরা রাস্তায় নামছেন, আজও মহল্লায় মহল্লায়, পাড়ায় পাড়ায় মিছিল হচ্ছে, কিন্তু সেই মিছিলে কোনও দ্বেষ নেই, ঘৃণা নেই। আছে সত্যিকারের দেশপ্রেম, সংবিধানকে রক্ষা করার সংকল্প। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এই মিছিলে থাকছেন। এটাই তো ঐক্যের ছবি। এই ভারতের স্বপ্নই তো পরের প্রজন্মকে দেখানো জরুরি। এটাই তো আসল বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য।
যখন রাষ্ট্র তার সমস্ত নাগরিকের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, তখন তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, পোশাক নির্বিশেষে সমস্ত নাগরিক— এটাই কি ঐক্যের দৃষ্টান্ত নয়? জাতীয় পতাকার বিক্রি বেড়ে যাওয়া কি সেই দিকেই দিকনির্দেশ করে না? এটাই কি প্রকৃত দেশপ্রেম নয়? উচ্ছাস এবং উন্মাদনা কোথাও যেন পিছনে ফেলে দিয়েছে ২০১৯ সালের পুলওয়ামা পরবর্তী প্রতিহিংসার দৃশ্যগুলোকে। আজ থেকে এক বছর আগেও শোনা যেত— ‘গর্ব করে বলো আমি হিন্দু’। এখন কিন্তু মুসলমান মানুষজন জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে তাঁদের মুসলমান জাতিসত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ করছেন এবং জোরের সঙ্গে বলছেন— ‘গর্ব করে বলছি আমি ভারতীয় মুসলমান’। অতি বড় উগ্র জাতীয়তাবাদীও এই সত্যিটাকে অস্বীকার করতে পারছেন না। ফলত, তাঁরা পিছু হটছেন এবং আরও আরও কুযুক্তি সামনে আনছেন।
‘এত বিদ্রোহ কখনও দেখেনি কেউ দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ’। তা হলে কি ২০২০ সাল কি নতুন কোনও সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে চলেছে? দেশের সর্বোচ্চ আদালতে, প্রধান বিচারপতি বোবদের বেঞ্চে মামলা হয়েছে। তিনি বলেছেন দেশে এই আন্দোলন কিছুটা শান্ত হলে তিনি এই শুনানি শুনবেন।
কিন্তু শান্ত করার দায়িত্ব কার? যাঁরা শান্ত করবেন, তাঁরাই উস্কানি দিয়ে চলেছেন ক্রমশ। কখনও বলছেন— সারা দেশে এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের পরে তাঁরা এনআরসি করে কোটি কোটি অনুপ্রবেশকারীদের দেশ থেকে বার করে দেবেন। কিন্তু কী পদ্ধতিতে করবেন তার কোনও সঠিক রূপরেখা নেই। শুধু হুমকি আর হুমকি! বলা হয়েছে, যা ইচ্ছে করুন কিন্তু এই আইন বন্ধ হবে না। কিন্তু এই কথাটা বলা হচ্ছে কেন যে, যত আন্দোলনই করুন না কেন এই আইনকে কোনও ভাবেই ফেরানো হবে না?
অসম এবং উত্তরপ্রদেশ মিলিয়ে পুলিশের গুলিতে এখনও অবধি মৃতের সংখ্যা ৩৫। তা সত্ত্বেও কেন প্রধান বিচারপতি কেন্দ্রীয় সরকারকে আরও চার সপ্তাহ সময় দিলেন? মহামান্য আদালতের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েও বলছি, এর কারণ খোঁজা জরুরি। যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, শুধুমাত্র নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে কোনও নাগরিকের কোনও ক্ষতি হবে না, তা হলেও বলা যায়, এর সঙ্গে যদি নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসিকে যুক্ত করা যায়, তা হলে সমাজের যাঁরা সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশ, তাঁরা আরও আশঙ্কা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবেন। ঠিক যে ভাবে গত একমাস বা তার একটু বেশি সময়ে ধরে মুসলমান মানুষজন রাস্তায় নেমেছেন, তাতে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে আরও মেরুকরণ করার কাজটা সহজে করা যাবে।
সবোর্চ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রেখেও প্রশ্ন তোলা যায়— সেই জন্যই কি আরও চার সপ্তাহ সময় দেওয়া হল?
মানুষ রাস্তায় নেমেছেন তাঁর বাঁচার তাগিদে। তাঁরা বলছেন এখনও যদি বাড়ি থেকে না বেরোন তা হলে হয়তো এক দিন দেশ থেকেই বেরিয়ে যেতে হবে। প্রধান বিচারপতির এজলাসে শুনানির সময়ে দেখা গিয়েছে যে মানুষেরা রাস্তায় নেমেছিলেন তাঁদেরই একটা অংশ ধীরে ধীরে জমা হয়েছেন সর্বোচ্চ আদালতের সামনে। তাঁরা জাতীয় পতাকাকে সঙ্গে করেই আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু আবারও তাঁরা হতাশ হয়েছেন। আশঙ্কিত হচ্ছেন।
এই লড়াই দীর্ঘ দিনের লড়াই। এই লড়াই জাতীয় পতাকাকে আবার রিক্লেইম করার লড়াই। সেটা বুঝতে পেরেছেন ওঁরাও। তাই রাষ্ট্রের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে লড়ে যেতে প্রস্তুত ওঁরা। ময়দান আঁকড়ে পড়ে থাকছেন প্রতিদিন। শাহিনবাগ হোক কিংবা পার্ক সার্কাস, জেএনইউ হোক কিংবা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়— ওঁরা জানাচ্ছেন আগামী এক মাসে আন্দোলন কোথাও থামছে না।
তবে আন্দোলনকে দিশা দেখিয়ে ঠিক পথে চালনা করতে হবে। এটা যে দীর্ঘ লড়াই, অনেক দিন লড়তে হবে— এটা অনেকেই বুঝতে পারছেন। কিন্তু কী ভাবে এই লড়াইটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, তা নিয়ে কেউ কেউ দ্বিধান্বিত। তবে এই লড়াইয়ে নাগরিক কিছুটা হলেও এগিয়েছেন। যার ফলেই জাতীয় পতাকা হাতে এই প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সঙ্ঘ পরিবারের সমর্থকদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। এই যে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলছেন— আরও শাহিনবাগ, আরও আরও পার্ক সার্কাস, আরও আসানসোল, আরও বহরমপুর উঠে আসা জরুরি— এটাই আসল চাবিকাঠি। এই নাগরিক বিকেন্দ্রীভূত লড়াইকে শাসক ভয় পায়। কারণ এই আন্দোলনকে তাঁরা কোনও বাম বনাম ডান বা কংগ্রেস বনাম বিজেপি বলে দাগাতে পারছে না। মানুষও বুঝে গিয়েছে এই ছোট ছোট বিকেন্দ্রীভূত লড়াইই পারে রাষ্ট্রশক্তিকে পরাজিত করতে। মানুষের স্পষ্ট ধারণা রয়েছে এই ধরনের ফ্যাসিস্ট শক্তি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় আসে। তাঁদের পরাজিত করার পদ্ধতি দীর্ঘমেয়াদি এবং রক্তক্ষয়ী। কিন্তু তবুও তাঁরা এখনও বিচারব্যবস্থায় আস্থা রেখেছেন। কারণ, দেশটা গণতান্ত্রিক।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার ও সমাজকর্মী