সংবাদের ফাঁদ

অপর দিকে মানহানির মামলা করিয়া সাংবাদিকদের স্বাধীনতায় রাশ টানিবার চেষ্টা চলিতেছে। এক শীর্ষস্থানীয় মহিলা সাংবাদিকের বাড়িতে হানা দিয়া পুলিশ তাঁহার পোশাকের তাক অবধি তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়াছে, ‘জাতীয় নিরাপত্তা-সংক্রান্ত তথ্য’ তিনি লুকাইয়াছেন কি না তাহা দেখিতে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৯ ০০:২৭
Share:

—ফাইল চিত্র

অস্ট্রেলিয়ার সংবাদপত্রগুলি সম্প্রতি তাহাদের প্রথম পাতার প্রতিটি বাক্য কালো রঙে ঢাকিয়াছে। ইহার দ্বারা তাহারা মনে করাইল, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ব্যাহত করিবার চেষ্টা আজও প্রবল ভাবে অব্যাহত। বিশ্বের দরবারে অস্ট্রেলিয়ার সরকার এই জন্য নিন্দিত হইয়াছে। এক দিকে জাতীয় নিরাপত্তার কারণ দেখাইয়া অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্ট নূতন নূতন আইন পাশ করিতেছে, যাহাতে গুরুত্বপূর্ণ নানা সরকারি সিদ্ধান্ত সংবাদের বাহিরে থাকে। অপর দিকে মানহানির মামলা করিয়া সাংবাদিকদের স্বাধীনতায় রাশ টানিবার চেষ্টা চলিতেছে। এক শীর্ষস্থানীয় মহিলা সাংবাদিকের বাড়িতে হানা দিয়া পুলিশ তাঁহার পোশাকের তাক অবধি তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়াছে, ‘জাতীয় নিরাপত্তা-সংক্রান্ত তথ্য’ তিনি লুকাইয়াছেন কি না তাহা দেখিতে। পুলিশ হানা দিয়াছে একটি বৃহৎ টিভি খবর সংস্থার দফতরেও। স্পষ্টতই ভয় দেখাইবার কৌশল। আক্ষেপ এই যে, এই অপচেষ্টা কেবল অস্ট্রেলিয়া কিংবা তাহার মতো কয়েকটি দেশে সীমাবদ্ধ নহে। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সকল দেশেই সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করিতে এবং সাংবাদিকের কণ্ঠরোধ করিতে সরকারগুলি সচেষ্ট। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশ কেবল ভৌগোলিক প্রতিবেশী নহে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকেও তাহাদের অবস্থান পরস্পরের কাছাকাছি। ওই সূচকে ভারতের অবস্থান গত কয়েক বৎসরে ক্রমাগত নিম্নগামী হইতেছে। সংবাদমাধ্যমের দফতরে আয়কর বিভাগ কিংবা পুলিশের তল্লাশি হইতে সাংবাদিকের হত্যা, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার মামলা, কিছুই বাদ যায় নাই। আক্ষেপ, ভারতের সংবাদমাধ্যম কিন্তু এমন একযোগে প্রতিবাদ করিবার সাহস খুঁজিয়া পায় নাই। অস্ট্রেলিয়ার সংবাদপত্রগুলির মধ্যে বাণিজ্যিক ও পেশাদারি রেষারেষি কিছু কম নাই। রাজনৈতিক অবস্থানেও তাহাদের যথেষ্ট পার্থক্য রহিয়াছে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে অস্ট্রেলিয়ার দৈনিকগুলির এই সম্মিলিত প্রতিবাদ ভারত তথা সমগ্র বিশ্বের নিকট একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করিল।

Advertisement

সেই দৃষ্টান্ত ভারতের সংবাদমাধ্যম কতখানি গ্রহণ করিতে পারিবে? করা উচিত ছিল। এ দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাতন্ত্র্য তথা সাংবাদিকের সুরক্ষা যে বিপন্ন, তাহা সুবিদিত। নূতন বিপদও আসিতেছে। সুপ্রিম কোর্টে একটি হলফনামায় কেন্দ্র জানাইয়াছে, ইন্টারনেটে বিদ্বেষমূলক বার্তা ও ভ্রান্ত সংবাদ নিয়ন্ত্রণ করিতে খুব শীঘ্রই কেন্দ্র ব্যবস্থা করিবে। অনভিপ্রেত বার্তার অর্থ? ‘জাতীয়তাবাদ-বিরোধী কার্যকলাপ এবং মানহানি করিয়া পোস্ট।’ বলা বাহুল্য, কেন্দ্রীয় সরকার ‘জাতীয়তা-বিরোধী’ বলিতে সাধারণত ‘সরকার-বিরোধী’ বুঝাইয়া থাকে, এবং সরকার তথা সরকার-ঘনিষ্ঠ যে কোনও ব্যক্তির সমালোচনাকে ‘মানহানি’ বলিয়া আখ্যা দেয়। ফলে ডিজিটাল দুনিয়াকে অপরাধমুক্ত করিবার অজুহাতে প্রশাসনকে বিরোধিতা-মুক্ত করিবার অপচেষ্টার আশঙ্কা অমূলক নহে। প্রসঙ্গত, সাংবাদিকের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মনোভাবটি সম্প্রতি ফের স্পষ্ট হইল অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁহার সতর্কবাণীতে। মোদী জানাইয়াছেন, সাংবাদিকরা তাঁহাকে দিয়া মোদী-বিরোধী কথা বলাইয়া লইতে পারে। ইহার অর্থ, সরকার-বিরোধী বাক্য অতীব মন্দ, স্বেচ্ছায় বলিবার বস্তুই নহে। মন্দ সাংবাদিকের ‘ফাঁদে পড়িয়া’ সমালোচনা বাহির হয়। সত্য এই যে, বেকারত্ব-সংক্রান্ত তথ্য গোপন করিবার জন্য অভিজিৎ-প্রমুখ বরেণ্য অর্থনীতিবিদ মোদী সরকারের তীব্র নিন্দা করিয়াছিলেন। সংবাদে তাহা প্রকাশিত হয়। সরকারের সমালোচনা আবারও তাঁহারা করিলে আবারও তাহা সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করিবে, ধরিয়া লওয়া যায়। অর্থাৎ দেশভক্তির ফাঁদে পড়িতে মোটেও রাজি নহেন সকল সাংবাদিক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement