চাহিদা নিয়ে সংশয়ের কাঁটা খচখচ করছে এখনও। ঝুঁকি মাপলে দুশ্চিন্তা যাচ্ছে না মুনাফা নিয়ে। আর সেই কারণেই প্রস্তাবিত ‘থিম সিটি’ প্রকল্পে লগ্নির শর্ত নমনীয় রাখার আর্জি নিয়ে রাজ্যের কাছে দরবার করছে নির্মাণ শিল্পমহল। সরকারকে টাকা মেটাতে কিছুটা বাড়তি সময়ের পাশাপাশি চাহিদা আঁচ করে জমি ব্যবহার করতে দেওয়ার জন্যও সওয়াল করছে তারা।
বোলপুর, আসানসোল, কল্যাণী, বারুইপুর, শিলিগুড়ির কাছে ডাবগ্রাম, এবং হাওড়ার ডুমুরজলায় ‘থিম’ (একটি করে নির্দিষ্ট বিষয়ের ভিত্তিতে) শহর তৈরির পরিকল্পনা করেছে রাজ্য। হাওড়ায় বিষয় খেলা, বারুইপুরে স্বাস্থ্য পরিষেবা, ডাবগ্রামে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, আসানসোলে শিল্প, বোলপুরে শিল্প-সংস্কৃতি আর কল্যাণীতে তথ্য বিশ্লেষণ। কিন্তু বিপুল টাকা ঢেলে এই সমস্ত প্রকল্প গড়ার পরে সেখানে চাহিদা কেমন হবে, সে বিষয়ে এখনও একেবারে নিঃসন্দেহ হতে পারেনি নির্মাণ শিল্প। সেই কারণে তারা চায়, চাহিদা মেপেই জমি ব্যবহারের নিয়ম-নীতি তৈরি করুক রাজ্য। প্রকল্পে কত একরে আবাসন হবে আর কতখানি জমিতে ‘থিম’ অনুযায়ী তৈরি হবে স্টেডিয়াম-কলেজ-হাসপাতাল, সেই বিষয়টি ঠিক হোক চাহিদার ভিত্তিতে। তাতে নমনীয়তা থাকুক। যাতে থিমের পরিকাঠামো বেশি গড়ে পরে চাহিদার অভাবে ভুগতে না হয় তাদের।
একই সঙ্গে নির্মাণ শিল্পের আর্জি, জমির লিজের টাকা মেটাতে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় দিক রাজ্য। এই সব বিষয়ে ইতিমধ্যেই সরকারের সঙ্গে দফায়-দফায় কথা বলেছে নির্মাণ সংস্থাগুলির সংগঠন ক্রেডাই।
প্রস্তাবিত প্রতিটি থিম শহরের জন্য জমির অভাব নেই। রয়েছে এক লপ্তে অন্তত ৫০ একর। ক্রেডাইয়ের পরামর্শ মেনে ধাপে ধাপে জমির দাম নিতেও রাজি হয়েছে রাজ্য। ছাড় দেওয়া হয়েছে ‘ফ্লোর এরিয়া রেশিও’ বা জমির অনুপাতে নির্মিত বর্গ ফুটের পরিমাণে। যাতে তুলনায় কম জমিতে বেশি বর্গ ফুট তৈরি করে লাভের অঙ্ক বাড়িয়ে নিতে পারে নির্মাণ সংস্থা। সে দিক থেকে দেখলে, লগ্নি টানার সব রসদই মজুত। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখনও দরপত্র জমা দেননি লগ্নিকারীরা।
এই প্রস্তাবিত শহরগুলির মধ্যে ডুমুরজলা আর বারুইপুর কলকাতার গায়ে লাগা। খুব দূরে নয় কল্যাণীও। আর বাকিগুলি দেড়শো থেকে সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার। নির্মাণ শিল্পের মতে, কলকাতা পেরোলেই ক্রমশ কমতে থাকে ব্যবসার জরুরি তিনটি উপকরণ। পরিকাঠামো (বিশেষত শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক পরিকাঠামো), বাজারের মাপ এবং ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতা। এ ক্ষেত্রেও এই তিনটি জিনিসের অভাবই বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে থিম সিটির পথে।
বণিকসভার এক কর্তার মতে, রাজ্যে সমান ভাবে শিল্পায়ন কখনও হয়নি। উন্নয়ন যেটুকু হয়েছে, তা কলকাতাকে ঘিরে। ফলে জেলাগুলিতে গড়পড়তা মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এক জায়গাতেই আটকে রয়েছে। এই কারণেই মুম্বইয়ের পাশে যে ভাবে পুণে বা নাগপুর গড়ে উঠেছে, এ রাজ্যে তা হয়নি। কলকাতার বাইরে সে ভাবে তৈরি হয়নি বাজার কিংবা কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগও।
ফলে এ সব প্রকল্প শেষমেশ কতটা লাভজনক হবে, তা নিয়ে নিঃসংশয় নয় নির্মাণ শিল্প। বিশেষত যেখানে খোদ কলকাতাতেই ২০১৬ সালের প্রথম ছ’মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ফ্ল্যাটের বিক্রি কমে গিয়েছে ১০%। যার মূলে রয়েছে নতুন ক্রেতার অভাব।
গত সেপ্টেম্বরে থিম শহর প্রকল্পের জন্য দরপত্র তৈরির কাজ শুরু করে ‘নোডাল এজেন্সি’ হিডকো। পরে বেঁধে দেওয়া হয় দরপত্র জমার সময়সীমা। লগ্নিকারীরা সে ভাবে আগ্রহ না-দেখানোয় পরে তা বাড়াতেও হয়। সেই অনুযায়ী, চলতি মাসের মধ্যেই সব প্রকল্পের ই-নিলাম শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু রাজ্য সরকারি সূত্রে খবর, তা হওয়া শক্ত। কারণ নির্মাণ শিল্পমহল আগ্রহী হলেও দরপত্র এখনও জমা পড়েনি। লগ্নির শর্তে নমনীয়তা সেই গেরো কাটাতে পারে বলে আশা অনেকের।