চুক্তি সই অনুষ্ঠানে ওয়ান্দা (দাঁড়িয়ে বাঁ দিক থেকে তৃতীয়), পাশে খট্টর। — পিটিআই
মাঝে ঠিক এক সপ্তাহ। আগামী শনিবার (৩০ জানুয়ারি) লগ্নির খোঁজে এ রাজ্যে আসছেন হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর। তার দিন সাতেক আগেই বিনিয়োগ প্রস্তাবে হরিয়ানার ঝুলি ভরে দিল চিন। সে দেশের দালিয়ান ওয়ান্দা গোষ্ঠী জানাল, খট্টরের রাজ্যে শিল্প-পার্ক (ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক) গড়তে ১,০০০ কোটি ডলার (৬৮ হাজার কোটি টাকা) লগ্নি করবে তারা।
ওই পার্ক তৈরির জন্য শনিবার চিনে আটটি সমঝোতাপত্র (মউ) সই করেছে হরিয়ানা সরকার। ওয়ান্দা গোষ্ঠী ছাড়াও চুক্তি সই হয়েছে চায়না ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি এবং জেটিই কর্পোরেশনের সঙ্গে। এ ছাড়া, ওই রাজ্যে ১০০ কোটি ডলার (৬,৮০০ কোটি টাকা) ঢালার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চিনের ১০০টিরও বেশি ক্ষুদ্র, ছোট এবং মাঝারি সংস্থা।
দেশ-বিদেশ থেকে হরিয়ানায় লগ্নি টানতে ৭ ও ৮ মার্চ গুড়গাঁওয়ে সম্মেলন (হ্যাপেনিং হরিয়ানা—গ্লোবাল ইনভেস্টর্স সামিট: ২০১৬) আয়োজন করছেন খট্টর। অনেকটা ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’, ‘রিসার্জেন্ট রাজস্থান’-এর ধাঁচে। তার আগে নিজের রাজ্যকে শিল্পের পছন্দের গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরতে দেশের বিভিন্ন শহর এমনকী বিদেশেও ছুটে বেড়াচ্ছেন তিনি। এক সপ্তাহের ব্যবধানে তাঁর বেজিং ও কলকাতায় পা রাখাও সেই কারণে।
বৃদ্ধির হার হঠাৎ ঝিমিয়ে পড়া চিনা মুলুক থেকে এই বিপুল অঙ্কের লগ্নি প্রস্তাব হরিয়ানার সম্মেলনের জৌলুস এক ঝটকায় অনেকখানি বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করছেন অনেকে। কিন্তু তেমনই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন এ রাজ্যের শিল্পমহলের একাংশ। তাঁদের আশঙ্কা, একেই পশ্চিমবঙ্গে শিল্প বাড়ন্ত। তার উপর খট্টরের ডাকে সাড়া দিয়ে এ রাজ্যের শিল্পপতিরাও জাঠ মুলুকে লগ্নি সরিয়ে নিয়ে যাবেন না তো?
এমনিতে এক রাজ্যের সংস্থা ব্যবসার কারণে অন্য রাজ্যে টাকা ঢালবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে এমন আশঙ্কা এ রাজ্যের শিল্পমহলের একাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে, তার কারণ দু’টি। এক, যে ওয়ান্দা গোষ্ঠী হাজার কোটি ডলার লগ্নির প্রস্তাব দিয়েছে, তাদের কৌলিন্য। আর দুই, শিল্পের পছন্দের জায়গা হিসেবে এ রাজ্যের হতশ্রী দশা।
হরিয়ানায় ১৩ বর্গ কিলোমিটারের উপর শিল্প পার্ক তৈরির কাজ এ বছরই শুরু করে দেওয়ার কথা বলেছে দালিয়ান ওয়ান্দা গোষ্ঠী। চিন তো বটেই, সারা এশিয়ায় তারা বেশ সমীহ জাগানো নাম। মূল ব্যবসা নির্মাণ। ঝুলিতে রয়েছে ১২৫টি শপিং প্লাজা, ৬৮টি পাঁচ তারা হোটেল। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সিনেমা চেনের মালিকও তারা। গত বছর ব্যবসার অঙ্ক ৪,৪০০ কোটি ডলার (প্রায় ৩ লক্ষ কোটি টাকা)।
চিনের ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতে ওই গোষ্ঠীর মতো সাড়া জাগানো নাম তার কর্ণধারেরও। একাধিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ওয়াং জিংলিং চিনে ধনীতম। বিশ্বে প্রথম পঞ্চাশে। নিট সম্পদ ২,৫০০ কোটি ডলার (১ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা)। এক সময়ে টানা ১৬ বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন ৬১ বছরের এই ধনকুবের। তারপরে ব্যবসা শুরু করে গড়েছেন চিনের বৃহত্তম নির্মাণ সংস্থা। স্পেনের পরিচিত ফুটবল ক্লাব অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের ২০ শতাংশ মালিকানাও তাঁর পকেটে। হরিয়ানার শিল্প পার্কই ভারতে জিংলিঙের প্রথম বিনিয়োগ।
অনেকে বলছেন, এ হেন সংস্থা আর তার কর্ণধারের কাছ থেকে প্রথম বারেই ৬৮ হাজার কোটি টাকার লগ্নি প্রস্তাব ছিনিয়ে আনা মুখের কথা নয়। চাট্টিখানি নয় সেই সঙ্গে এক লপ্তে ১০০টি ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি চিনা সংস্থার মন জয়ও। যার মধ্যে রয়েছে বস্ত্র, ইঞ্জিনিয়ারিং, গাড়ির যন্ত্রাংশ, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি সংস্থা। এক লপ্তে বড় জমি থেকে শুরু করে ব্যবসা শুরুর রাস্তা যথাসম্ভব মসৃণ করার উপায়— এই সমস্ত কিছু পকেটে না-থাকলে, এ ভাবে বড় বিনিয়োগ টানা শক্ত। খট্টর যেমন চিনের মাটিতে দাঁড়িয়ে দাবি করেছেন, কৌশলগত অবস্থান, পরিকাঠামো এবং সব সময় পাশে থাকা সরকারের মাপকাঠিতে তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া শক্ত। রাজ্যের শিল্পমহলের একটি অংশের মৃদু আশঙ্কাও মূলত সেই কারণে।
গত বছর রাজস্থানে লগ্নি সম্মেলনের আগে ২১ এপ্রিল কলকাতায় এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে। বক্তৃতার মঞ্চে নিজের রাজ্যকে লগ্নির পছন্দের গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরা ছাড়াও আলাদা ভাবে মুখোমুখি বসে কথা বলেছিলেন এ রাজ্যের অনেক শিল্পপতির সঙ্গে। জানতে চেয়েছিলেন, বিনিয়োগ করার জন্য কী কী সুবিধা তাঁরা চান। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে মরুভূমির দেশে লগ্নির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল এ রাজ্যের শিল্প। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এ রাজ্যে টাকা ঢালার পরে যদি এখানকার শিল্প অন্যত্র লগ্নি করে, তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু অন্যত্র বিনিয়োগের জন্য যদি এখানে টান পড়ে, তা হলে মুশকিল।
দাভোসে বিশ্ব আর্থিক সম্মেলনের ফাঁকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজন বলছিলেন, এই মুহূর্তে ভারতের অর্থনীতির অন্যতম ভাল দিক লগ্নি টানতে রাজ্যগুলির মধ্যে মারকাটারি প্রতিযোগিতা। এ রাজ্যে বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলনের মঞ্চে ওই একই কথা বলে গিয়েছেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও।
নিজেদের লগ্নির গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরতে এখন সম্মেলন আয়োজন করছে অধিকাংশ বড় রাজ্য। বিনিয়োগ টানতে বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার কথা বলছে তারা। বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও দাবি করেছেন, শিল্পকে দেওয়ার মতো জমি তাঁদের হাতে মজুত। তৈরি এক-জানলা ব্যবস্থাও। কিন্তু শিল্পমহলের অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গে লগ্নির পায়ে জমি-জটের শেকল। ঊর্ধ্বসীমার বেড়ি। সঙ্গে ‘উপরি পাওনা’ লাল ফিতের ফাঁস। তাঁদের সংশয়, এত কিছুর পরেও অন্য রাজ্যগুলির কাছ থেকে আসা বিভিন্ন সুবিধা সমেত লগ্নির সাদর আমন্ত্রণ কি সত্যিই ফিরিয়ে দেবেন সকলে?
এমন নয় যে, সমস্যা অন্যত্র নেই। কিছু দিন আগে এই হরিয়ানাকেই শ্রমিক বিক্ষোভের আঁচে পুড়তে দেখেছেন সকলে। কিন্তু সে সব সত্ত্বেও শিল্পের সমস্যা বুঝতে সরকার কতটা আন্তরিক, টাকা ঢালার আগে তা জরিপ করেন লগ্নিকারীরা। এই লড়াইয়ে পশ্চিমবঙ্গ বাকি রাজ্যের সঙ্গে কতখানি টক্কর দিতে পারবে, তার উপরই এ রাজ্যের শিল্প-ভবিষ্যৎ অনেকখানি নির্ভরশীল বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।