ধোপে টিকছে না কর আদায় নিয়ে জেটলির দাবি

চার দিক থেকে ধেয়ে আসা সমালোচনার মুখে অর্থমন্ত্রীর দাবি, নোট বাতিলে বিবর্ণ হয়নি অর্থনীতির ছবি। সেই রঙিন ছবি আঁকতে গিয়ে তাঁর যুক্তি, নোট নাকচের সব থেকে বেশি প্রভাব পড়ার কথা ডিসেম্বরে। অথচ কর আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে তখনও।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৭ ০২:২৭
Share:

চার দিক থেকে ধেয়ে আসা সমালোচনার মুখে অর্থমন্ত্রীর দাবি, নোট বাতিলে বিবর্ণ হয়নি অর্থনীতির ছবি। সেই রঙিন ছবি আঁকতে গিয়ে তাঁর যুক্তি, নোট নাকচের সব থেকে বেশি প্রভাব পড়ার কথা ডিসেম্বরে। অথচ কর আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে তখনও। কিন্তু পুরো পরিসংখ্যানকে আতসকাচের তলায় রাখলে, অরুণ জেটলির ওই দাবি ধোপে টিকছে না। বরং নোটবন্দির ধাক্কায় ফ্যাকাসেই দেখাচ্ছে কর আদায় আর অর্থনীতির ছবিকে।

Advertisement

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন থেকে শুরু করে ছোট ও মাঝারি শিল্প— নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে অর্থনীতি ধাক্কা খাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলছেন সকলেই। এই পরিস্থিতিতে জেটলির দাবি ছিল, নোট বাতিলে অর্থনীতি ধাক্কা খায়নি। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০১৬-র শেষ মাসে কর আদায় বেড়েছে ৩১%। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর—অর্থবর্ষের প্রথম ন’মাসে আয়কর, কোম্পানি করের মতো প্রত্যক্ষ কর আদায় বেড়েছে ১২.০১%। আর উৎপাদন শুল্ক, পরিষেবা করের মতো পরোক্ষ কর বেশি এসেছে ২৫%। এমনকী তা বেড়েছে ডিসেম্বরেও। নোট নাকচের প্রভাব যে-মাসে সবচেয়ে বেশি থাকার কথা। তাঁর যুক্তি, অর্থনীতি সত্যিই ধাক্কা খেলে এমন ঘটত না।

কিন্তু এখন সেই রাজস্ব আদায়েরই পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতিতে ধাক্কা লাগার লক্ষণ স্পষ্ট। কারণ, আগের বছরের তুলনায় ডিসেম্বরে কর আদায় বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মাসগুলিতে যে-হারে কর আদায় বেড়েছে, নোট বাতিলের পরে তা ঝিমিয়ে পড়েছে নভেম্বর-ডিসেম্বরে।

Advertisement

যেমন, জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত উৎপাদন শুল্ক আদায় বেড়েছে যথাক্রমে ৫৪, ৩৬, ৩৬, ও ৪০ শতাংশ। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে তা ৩২ শতাংশের আশেপাশে। জুলাইয়ে পরিষেবা কর আদায় যেখানে ২৪% বেড়েছিল, সেখানে ডিসেম্বরে তা ১২.৪%। অক্টোবরে পরোক্ষ কর আদায় বৃদ্ধির হার ছিল ৩৫.৮%। অথচ ডিসেম্বরে তা নেমে এসেছে ১৪ শতাংশের আশেপাশে। আর এই একই ছবি ধরা পড়েছে কর আদায়ের প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একেই শুধু রাজস্ব আদায় কখনও অর্থনীতির আয়না হতে পারে না। ইউপিএ-জমানার সবচেয়ে খারাপ বছরেও (২০১৩-’১৪) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আদায় ১৪-১৫ শতাংশ বেড়েছিল। আর তার উপর এখন দেখা যাচ্ছে, অর্থমন্ত্রীর পেশ করা পরিসংখ্যানেও ফাঁকফোকর রয়েছে যথেষ্ট। ফলে তাঁর যুক্তি কতটা ধোপে টিকছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।

সিটি রির্সাচের বিশ্লেষণ বলছে, পরোক্ষ কর আদায় বাড়ার পিছনেও আসল কারণ অর্থনীতির বাড়বাড়ন্ত নয়, পেট্রোল-ডিজেলের শুল্ক বৃদ্ধি। একই মত কর বিশেষজ্ঞ মুকেশ বুটানিরও।

যুক্তির গলদ ধরা পড়ছে আয়কর জমা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও। প্রাক্তন মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেনের বক্তব্য, ‘‘বাতিল নোটে আগাম কর জমার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সেখানেই বোধহয় উত্তর লুকিয়ে রয়েছে।’’ উল্লেখ্য, বাতিল নোটে ডিসেম্বর পর্যন্ত আগাম কর জমার সুযোগ দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রক। স্বেচ্ছায় কালো টাকা ঘোষণার প্রকল্পেও প্রথম কিস্তির কর মেটানোর নিয়ম ছিল।

প্রাক্তন মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ ভিরমানির মতে, ‘‘নোট বাতিলের জেরে আগামী মাসগুলিতে বৃদ্ধির হার কমলে রাজস্ব আয় আরও কমবে।’’ আর বৃদ্ধির হার যে নামবে, তা নিয়ে প্রায় সকলেই একমত। খোদ পরিসংখ্যান মন্ত্রকই বৃদ্ধির পূর্বাভাস ৭.১ শতাংশে নামিয়েছে। তা-ও নোট বাতিলের প্রভাব হিসেব না করে।

অল ইন্ডিয়া ম্যানুফাকচারার্স অর্গানাইজেশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, নোট বাতিলের পরে এক মাসেই ছোট-মাঝারি শিল্পের আয় ৫০% কমেছে। কর্মসংস্থান কমেছে ৩৫%।

রক্ষা পায়নি বড় কারখানা, রফতানি ক্ষেত্র। পরিকাঠামো ও নির্মাণ শিল্পেও আয় এবং কর্মসংস্থান ৪০% কমেছে। নাইট ফ্র্যাঙ্ক ইন্ডিয়ার সমীক্ষা দেখাচ্ছে, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে বাড়ি-ফ্ল্যাটের বিক্রি কমেছে। একই ছবি গাড়ি বিক্রি নিয়ে নির্মাতা সংস্থাগুলির সংগঠন সিয়ামের হিসেবে। বাইক-স্কুটার বিক্রি কমায় ডিসেম্বরে গাড়ি বিক্রি নেমেছে গত ১৬ বছরের তলানিতে।

সম্প্রতি মনমোহন সিংহ ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, ‘‘আসল বিপর্যয় এখনও বাকি।’’ সব মিলিয়ে, সেই আশঙ্কাই সত্যি হতে পারে বলে ধারণা অনেকের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement