Ananda Utsav 2024

মনসাতলায় হয় নবমীর বলি, লক্ষ্মী-সরস্বতীর বদলে ধানের কৌটো ও দোয়াত— জেনে নিন দত্তবাড়ির পুজোর আশ্চর্য গাথা

অদ্ভুত এই বঙ্গদেশ আর অদ্ভুত মায়ের কথা। মা এখানে কন্যা হয়ে, মা হয়ে অদ্ভুত সব লীলা দেখিয়ে চলেন। না হলে, উপরের কথাটি ভাবুন না! প্রায় দু’শো বছর ধরে মা পুজো পেয়ে আসছেন বর্ধমান তেলুয়ার দত্তবাড়িতে।

Advertisement

তমোঘ্ন নস্কর

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:২৬
Share:

দত্ত বাড়ির মা দুর্গা

পুরনো মনসা গাছটি বছর শেষে নেতিয়ে পড়ল। মেঘ ঘনিয়ে এল দত্তবাড়ির সবার মনে। তবে কি মা রুষ্ট হয়েছেন? তিনি কি শাক্ত মত পরিত্যাগ করে বৈষ্ণব মতে পুজোর বলি গ্রহণ করতে চান না? কিন্তু সবাইকে অবাক করে ঠিক সেই স্থল থেকেই অঙ্কুরিত হল আর একটি মনসা গাছের চারা। এবং নির্দিষ্ট নিয়মে প্রতি বছর পুরনো মনসা গাছের জায়গায় কেবল একটি করেই নতুন মনসা গাছের চারা তৈরি হয়। সেখানেই বলির অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।

Advertisement

অদ্ভুত এই বঙ্গদেশ আর অদ্ভুত মায়ের কথা। মা এখানে কন্যা হয়ে, মা হয়ে অদ্ভুত সব লীলা দেখিয়ে চলেন। না হলে, উপরের কথাটি ভাবুন না! প্রায় দু’শো বছর ধরে মা পুজো পেয়ে আসছেন বর্ধমান তেলুয়ার দত্তবাড়িতে। সন্তান মাকে ছাড়েনি আর মা-ও সন্তানকে ছাড়েননি— এ এক অদ্ভুত কাহিনি।

সে প্রায় আড়াইশো বছর আগের কথা। সামান্য এক ফৌজদারি কর্মচারী থেকে তীক্ষ্ণ ধী এবং মায়ের আশীর্বাদে প্রবল প্রতাপশালী ভূস্বামী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন রামভদ্র দত্ত। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মায়ের পুজো চালু করেছিলেন নিজের বংশে। চণ্ডী মণ্ডপ গড়ে দুর্গাপুজোয় মায়ের সেবা করতেন তিনি।

Advertisement

সময় গড়ায়। পরিস্থিতি বদলায়। রামভদ্রের তৃতীয় পুরুষ তখন, তীব্র অভাব অনটন এসে ছোবল মারে বংশে। ভূসম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জেরে ভাগ হয়ে গেলেন তিন জন পৌত্র। অশান্তি চরমে উঠল ভাইয়ে-ভাইয়ে। কিন্তু একটি বিষয়ে তিন ভাই-ই একমত ছিলেন। কোনও মায়েরই ভাগ হবে না। যা হবে, সব যৌথ ভাবেই হবে। তিন বাড়ি থেকেই পুজোর নৈবেদ্য আসবে। সারা বছর যতই অশান্তি থাক; পুজোর সময়ে সব ভুলে এক হয়ে মায়ের পুজো হবে। সম-অধিকার বজায় থাকবে। কারও পরিবারে আর্থিক অনটন হলে বাকিরা ষোলো আনা দিয়েও মায়ের সেবা করবে। সংকল্পের ক্ষেত্রে সকলেরই সমান অধিকার থাকবে। মা সবই দেখলেন। জাঁকজমকহীন এই নিষ্ঠাটুকু আপন প্রসাদ হিসেবে নিলেন। আর একটু পরীক্ষা নিলেন বটে, কিন্তু আশীর্বাদের হাতটা উপুড় করে রাখলেন।

ধীরে ধীরে অবস্থা খারাপ হয়ে আসছিল। ছোট ছোট মামলা-মোকদ্দমায় সবই গেল। আঁধার ঘনাল দত্তবাড়ির ভাগ্যাকাশে। মা লক্ষ্মী বাড়ি ছাড়লেন ঠিকই, কিন্তু মা দুর্গা সন্তানকে ছাড়েননি তখনও।

সন্তানও ছাড়েনি মা-কে। তিন শরিকই দাঁতে দাঁত চেপে পুজো করে চলেছিল। প্রাণ গেলেও শরতের ঢাক বাজবে, অথচ চণ্ডীমণ্ডপ খালি থাকবে— এ হয় না। মা সব দেখলেন। মেঘলা দিনে চন্দ্রোদয়ের মতো এগিয়ে এল তাদেরই এক জামাইয়ের পরিবার, ঘোষ পরিবার। টানা দশ বছর ঘোষেরা দত্তদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেল পুজোকে।

মায়ের পরীক্ষা নেওয়া শেষ হলো। সন্তোষ দত্ত, রামভদ্র দত্তের অধস্তন পঞ্চম পুরুষ আবার তাঁদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করলেন। মহা জাঁকজমকে শুরু হল পুজো। তবে এর মধ্যে তিনি বৈষ্ণব দীক্ষা নিয়েছেন। শাক্তমত থেকে বৈষ্ণব মতে শুরু হল পুজো। আগে যেখানে নবমীতে ছাগবলি হত, সেখানে একটি চালকুমড়ো ও ছ'টি নারকেলের বলি হলো। মায়ের ভৈরব শম্ভুনাথ মন্দিরের পার্শ্বস্থিত মনসা গাছটির তলায়। আর সেখানেই ঘটে গেল এক বিস্ময়! আশ্বিনের শুক্ল প্রতিপদে মায়ের বোধন। নারায়ণের নামে ঘট পড়ে। ঘটের পুজো হয়, তার পরে শুরু হয় মায়ের পুজো। দত্তবাড়ির পুজোয় সে বার অদ্ভুত ভাবে চারটি ঘট পড়ে। নারায়ণ, লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং মা দুর্গা— সবাইকে স্তুতি ও বন্দনা করে দত্তবাড়ির পুজো শুরু হয়। সে পুজো আজও চলছে।

দত্তবাড়ির আর একটি অভিনব প্রথা হল, প্রত্যেক শরিক এখানে লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর প্রতীক হিসেবে স্থাপন করেন যথাক্রমে ধানের কৌটো এবং দোয়াত-কলম। পুজোর শেষে দশমীর পর এই প্রতীকগুলো পৌঁছে দেওয়া হয় বাড়িতে। দত্তবাড়ির গৃহকর্ত্রী স্বয়ং আদ্যা। পরিবারের বিশ্বাস, তিনিই মাথায় আশীর্বাদের হাত তুলে রেখে চলেছেন।

এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement