Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

শাসক ‘কোটা’য় চাকরি ভাগ, প্রবল অসন্তোষ ঘরে-বাইরে

কেউ তৃণমূল নেতার স্ত্রী। কেউ তৃণমূল নেতার ঘনিষ্ঠজনের ভাগ্নে, কেউ বা বোন। কেউ আবার নিজেই শাসকদলের সক্রিয় কর্মী! টেটের পর এ বার সমবায় ব্যাঙ্কের কর্মী নিয়োগ ঘিরে ফের স্বজনপোষণের অভিযোগ উঠল রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধে।

বরুণ দে
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:৩৫
Share: Save:

কেউ তৃণমূল নেতার স্ত্রী। কেউ তৃণমূল নেতার ঘনিষ্ঠজনের ভাগ্নে, কেউ বা বোন। কেউ আবার নিজেই শাসকদলের সক্রিয় কর্মী!

টেটের পর এ বার সমবায় ব্যাঙ্কের কর্মী নিয়োগ ঘিরে ফের স্বজনপোষণের অভিযোগ উঠল রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধে। বুধবার থেকে মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর সমবায় ব্যাঙ্কের ৩৮টি শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ শুরু হয়েছে। যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগের সঙ্গেই তৃণমূল-যোগ স্পষ্ট। ফলে অনিয়মের অভিযোগে সরব হয়েছেন বিরোধীরা।

মোট ৩৮টি শূন্যপদের (১৮টি গ্রুপ-সি, ২০টি গ্রুপ ডি) নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা হয় গত ২৯ নভেম্বর। গ্রুপ-সি পদে ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল, মাধ্যমিকে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ এবং কম্পিউটারে প্রাথমিক জ্ঞান থাকা। গ্রুপ-ডি পদে ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল অষ্টম শ্রেণি পাশ। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১১ হাজার। ফলপ্রকাশ হয় গত ১৮ জানুয়ারি। প্রায় ২৫০ জনকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। পরে তার চূড়ান্ত ‘প্যানেল’ তৈরি হয়।

গত সোমবার ব্যাঙ্কের পরিচালন সমিতির বৈঠক ছিল। ওই বৈঠকেই ‘প্যানেল’ অনুমোদন হয়। মঙ্গলবার থেকে শুরু হয় নিয়োগপত্র বিলি। বুধবার থেকে দফায় দফায় কাজে যোগ দেন অনেকে। যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন পূজা হাজরা, সুশোভন মাইতি, সাবিয়া আখতারি, শুভজিত্‌ বসু, প্রিয়ঙ্কা প্রধান, দানেশ আহমেদ প্রমুখ।

পূজা পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সভাধিপতি উত্তরা সিংহ হাজরার মেয়ে। সুশোভন তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেন রায়ের ‘ছায়াসঙ্গী’ বলে পরিচিত। সাবিয়া খড়্গপুর-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। শুভজিত্‌ মেদিনীপুরের পুরপ্রধান প্রণব বসুর ভাইপো। প্রিয়ঙ্কা মোহনপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তপন প্রধানের মেয়ে। দানেশ তৃণমূলের সংখ্যালঘু সেলের নেতা আরিফ আহমেদের ছেলে। এমন উদাহরণ আরও বহু।

আর এই সব উদাহরণ তুলেই সরব হয়েছেন বিরোধীরা। তাঁদের অভিযোগ, দিন কয়েক আগে পটাশপুরে ভরা কর্মী-সম্মেলনে তৃণমূল সাংসদ শিশির অধিকারী কর্মী-সমর্থকদের আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, মৌখিক পরীক্ষায় সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তৃণমূলের লোকই থাকেন। ফলে, দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা যাতে চাকরিটা পান, সেটা তাঁরা দেখবেন।

ডিওয়াইএফের জেলা সম্পাদক দিলীপ সাউ বলেন, “তৃণমূল আমলে তো এটাই রীতি। সে এসএসসি হোক কিংবা প্রাথমিক।” বিজেপির যুব মোর্চার জেলা সভাপতি অরূপ দাসের অভিযোগ, “ব্যাঙ্কে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের একাংশ নেতাদের আগাম ‘প্রণামী’ দিয়ে রেখেছিলেন।’’

চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে তৃণমূলের অন্দরেও। লিখিত পরীক্ষার ফল বেরনোর পরে মেদিনীপুরে দলীয় কার্যালয়ে দলেরই এক জেলা কার্যকরী সভাপতির সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ান এক ছাত্রনেতা। ওই ছাত্র-নেতা লিখিত পরীক্ষায় সফল হননি। ভরা কার্যালয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আমরা যাঁরা কলেজে মার খেলাম, দলের জন্য এত খাটলাম, তাঁদের চাকরি হবে না! শুধু নেতানেত্রীদের ছেলেমেয়েদেরই চাকরি হবে!’’

তৃণমূলেরই একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, এই চাকরির জন্য দলীয় নেতাদের মধ্যে ‘কোটা’ ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি দেখভালের জন্য জেলা ও শহর এলাকার নেতাদের নিয়ে একটি ‘টিম’ও গড়া হয়। তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেন রায় একাধিক নাম সুপারিশ করেন বলে ওই সূত্রটির দাবি। যার মধ্যে ছিল দলের সংখ্যালঘু শাখার নেতা মহসিন খানের স্ত্রী সাইদা বেগমের নামও। সাইদার চাকরিও হয়েছে। দীনেনবাবুর অবশ্য দাবি, “কিছু জানি না! কারও নাম সুপারিশও করিনি!”

অভিযোগ উড়িয়েছেন সেই সব তৃণমূল নেতাও, যাঁদের ঘনিষ্ঠরা চাকরি পেয়েছেন। পুরপ্রধান প্রণব বসুর মন্তব্য, “যাঁরা নিয়োগপত্র পেয়েছেন, তাঁরা কারও না কারও ছেলেমেয়ে হবেনই!” মোহনপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তপন প্রধান বলেন, “মেয়ে পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়েছে। এতে অন্যায়ের কী!” যা শুনে এক সিপিএম নেতার টিপ্পনী, ‘‘তা হলে তো ধরে নিতেই হবে, শাসকদলের ঘনিষ্ঠ এত বেশি সংখ্যক লোকের চাকরি পাওয়াটা একেবারে কাকতালীয়!”

রাজনৈতিক চাপান-উতোরের মধ্যে ঢুকতে চাননি পরীক্ষা দিয়ে না চাকরি পাওয়া তরুণ-তরুণীরা। তাঁদেরই এক জন কৌশিক পাত্র বললেন, ‘‘ভাল পরীক্ষা দিয়েছিলাম! হতাশ লাগছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE