Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

জাতপাত ও উন্নয়ন আসলে গভীর ভাবে যুক্ত

বিহারে উন্নয়ন যেন দুমুখো তলোয়ার। এটা দিয়ে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা মেটানো যায়। আবার এর জন্যই আরও আশা-আকাঙ্ক্ষা জন্মায়। এই জন্যই উন্নয়ন জাতপাতের প্রশ্নটাকেও অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে পারে না।বিহারে উন্নয়ন যেন দুমুখো তলোয়ার। এটা দিয়ে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা মেটানো যায়। আবার এর জন্যই আরও আশা-আকাঙ্ক্ষা জন্মায়। এই জন্যই উন্নয়ন জাতপাতের প্রশ্নটাকেও অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে পারে না।

 সেই সময়। সদ্য-মুখ্যমন্ত্রী জিতনরাম মাঁজি (বাঁ দিকে) ও বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। ২০ মে, ২০১৪।

সেই সময়। সদ্য-মুখ্যমন্ত্রী জিতনরাম মাঁজি (বাঁ দিকে) ও বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। ২০ মে, ২০১৪।

বদ্রী নারায়ণ
শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৫ ০০:৫৫
Share: Save:

এ দেশের গণতন্ত্রে পরস্পরবিরোধিতার কোনও শেষ নেই। এক দিকে উন্নয়নের ভাবনা, সাম্যের স্বপ্ন, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার তৈরির শপথ। অন্য দিকে গণতন্ত্র আর উন্নয়ন দুই-এরই নির্ভর জাতপাত, ধর্ম ইত্যাদি পরিচয়ের উপর। সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক বোধগুলো এই দু’দিকের ভারসাম্য রাখতে রাখতেই এগিয়ে চলেছে। কখনও উন্নয়নের প্রশ্নটি সামনে চলে আসছে। কখনও জাতপাত বা ধর্মের প্রশ্নটিই ব়ড় হয়ে উঠছে। কখনও আবার দুই দিকই সমান গুরুতর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। গণতন্ত্র আর গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তগ্রহণের পদ্ধতির মধ্যে এই যে বিরোধিতা, বিহারেই সেটা সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো।

অদ্ভুত রাজ্য এই বিহার। উত্তরপ্রদেশের এবড়োখেবড়ো রাস্তা ধরে দুই রাজ্যের সীমানা পেরিয়ে বিহারের ঢোকামাত্র রাস্তা হয়ে যায় মসৃণ। মাখনের মতো রাস্তার দুই পাশে দেখা যায়, ছোট ছোট মেয়েরা ইউনিফর্ম পরে বইখাতা নিয়ে সাইকেল চড়ে স্কুলে চলেছে। গ্রামে গ্রামে সৌরশক্তির আলো। উত্তরপ্রদেশ-বিহার সীমানার খুব কাছে বক্সার বলে যে ছোট জায়গাটি, দিনে ১৬-১৭ ঘণ্টা বিদ্যুৎ মিলবেই সেখানে। বিদ্যুৎ-এর কারণে অন্যান্য সুযোগসুবিধেও অনেক সহজলভ্য, সহজভোগ্য। অর্থাৎ উন্নয়নের সাধারণ মাপকাঠি হিসাবে যে সব জিনিসকে ধরা হয়: বিদ্যুৎ, রাস্তা, জল, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি— তার নিরিখে হিন্দিভাষী অঞ্চলগুলির মধ্যে বিহার বেশ খানিকটা উপরে।

কিন্তু যদি কান পেতে মানুষের কথা শুনি? ক্ষোভ ও বঞ্চনার গজগজানি শুনতে পাব। অর্থাৎ এই রাজ্যে ভাল জীবন এবং আরও ভাল জীবনের আকাঙ্ক্ষাটাও অনেক বেশি, ক্রমবর্ধমান। গণতন্ত্র যতই গভীর হচ্ছে, আকাঙ্ক্ষাও যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আমরা অনুমান করতে পারি, যে উন্নয়নের পথে পরিকাঠামোর একটা সাময়িক উন্নতি হয়, কিন্তু ক্রমোন্নতির ধারাবাহিকতা তৈরি হয় না, সেই উন্নয়ন তৃপ্তির বদলে অতৃপ্তিটাই বেশি জাগিয়ে দেয়।

বিহারে ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজ করতে গিয়েও দেখেছি, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের ফলে যে যে পরিবর্তন ঘটেছে, সে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের না-পাওয়ার দিকগুলোর উপরও একই রকম জোর দেয়। বক্সার অঞ্চলের বাসিন্দারা কিছু কাল আগেই মৌলিক পরিকাঠামোর বিরাট উন্নতির সাক্ষী হয়েছে। গ্রামের ভিতরে তড়িতায়িত রাস্তা, গ্রামের বাইরে ধাতব পাকা় রাস্তা। দারিদ্রের ফাঁদ থেকে তাদের টেনে তোলার জন্য সরকার যে একটা চেষ্টা করছে, তার স্পষ্ট প্রমাণ। অবশ্য দারিদ্রের কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই স্পষ্ট হওয়া দরকার একটি বিষয়: বেশির ক্ষেত্রেই কিন্তু দারিদ্রের ধারণাটা পণ্য-ভিত্তিক নয়। চার পাশের পরিস্থিতি, উন্নয়ন, এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের অবস্থান— দুই দিক মিলিয়েই এই ধারণা তৈরি হয়। উন্নয়নের ফলে এক শ্রেণির মানুষ উপকৃত হন, তাঁদের জীবনধারণের পরিবর্তনটা অন্যদেরও চোখে পড়ে। তারও নীচু শ্রেণিতে যাঁরা, আরও সত্যি অর্থে ‘সাব-অল্টার্ন’, তাঁরা ততটা উপকার পান না। মজার ব্যাপার হল, দারিদ্রের অনুভূতিটাকেই যখন দারিদ্রের রাজনীতি হয়ে যায়, মধ্যবিত্ত শ্রেণিও তখন এর মধ্যে ঢুকে পড়ে, কেননা এই একটি শ্রেণি সব সময়েই কোনও না কোনও ভাবে নিজেদের বঞ্চিত ভাবতে অভ্যস্ত। বক্সারের এক বাসিন্দা আমাদের বুঝিয়ে বলেন, নীতীশ কুমারের সরকার রাজ্যের উন্নয়নের অনেক চেষ্টা করেছে ঠিকই, কিন্তু বিহারের লোক এখন যেন আরও বেশি করে দারিদ্রের কামড়টা টের পাচ্ছে। সরকারের উপর মানুষের নির্ভরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাহিদাও সমান তালে, কিংবা দ্রুততর তালে, বেড়ে চলেছে।

ফলত, বিহারের সমস্যাটার অনেকগুলো দিক। একে তো উন্নয়নের অভিজ্ঞতার ফলে উদ্ভূত প্রতিযোগিতার আবহাওয়া। তার উপর রয়েছে, মানসিক চাহিদা বেড়ে চলার সমস্যা। তৃতীয়ত, চাহিদা বাড়ার ফলে সরকারি পরিকাঠামোর উপর নিজেদের নির্ভরশীলতা নিয়ে নিজেদেরই ক্ষোভ। সব মিলিয়ে, উন্নয়ন-পরবর্তী বছরগুলিতে যখনই কোথাও গ্রামাঞ্চলে বা ছোট শহরে ভোট নিয়ে আলোচনা হয়েছে, প্রধান বিষয় হিসেবে উঠে আসছে জাতপাত। উন্নয়ন নয়। কোন দল ভাল করবে? মানুষ কাদের পছন্দ করছে? কে কাকে ভোট দেবে? সব প্রশ্নেরই আলোচনা এবং মীমাংসা হয়ে চলেছে জাতপাতের নিরিখে। আমাদের সমীক্ষা বলছে, মানুষ জানে যে নীতীশ সরকারের উন্নয়ন নীতির ফলে বিহারবাসীর বেশ একটা আত্মপ্রত্যয় তৈরি হয়েছে, বড় ধরনের দুর্নীতিও কমেছে। (ছোটখাট দুর্নীতির উপর অবশ্য কারও কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।) তা ছাড়া, নীতীশ কুমার সম্পর্কে সকলেরই ধারণা, তিনি মোটের উপর পরিচ্ছন্ন চরিত্রের লোক। তবুও, নীতীশের দল জেডি(ইউ)-র মূল সমর্থন-ভিত্তি কিন্তু মহাদলিত, কোরি, কুর্মি, অন্যান্য কিছু মধ্যবর্তী জাত, এবং হাতে-গোনা দু-একটি উচ্চ জাত গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। উল্টো দিকে, যাদব আর মুসলিম ভোট যায় লালু প্রসাদ যাদবের শিবিরে, যদিও অনেকেরই মতে, তাঁর আমলেই রাজ্যের উন্নয়নের গুরুতর ক্ষতি হয়েছিল। যাদবরা বিহারের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ। তাই বিহারে নীতীশ কুমার উন্নয়নপুরুষ হিসেবে যতই প্রতিভাত হোন না কেন, লালুর সঙ্গে সন্ধি অর্থাৎ যাদব সমর্থনের পরিমাণটার উপরই নির্ভর করছে তাঁর সাফল্যের সম্ভাবনা।

এই প্রেক্ষিতে ভাবা যেতে পারে, জিতনরাম মাঁজি কেন এ বার বিধানসভা নির্বাচনে এত গুরুতর ভূমিকা পালন করতে চলেছেন। ধরে নেওয়া যায়, তিনি মহাদলিত ভোটের ৫ শতাংশ মতো পাবেন, মুশাহার ভোট প্রায় পুরোটাই তাঁর দিকে যাবে। বিহারের ১৯টি মহাদলিত গোষ্ঠীর মধ্যে মুশাহাররা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, রাজনৈতিক ভাবে সবচেয়ে সক্রিয়। সাম্প্রতিক অতীতে মুশাহারদের মধ্যে যে ভাবে রাজনীতিকরণ হয়েছে, তার তুলনা মেলা ভার। সামাজিক ন্যায়ের অজুহাতে নীতীশ কুমার ও লালুপ্রসাদের দুই সরকারই এদের উপর বিশেষ রকম মনোনিবেশ করেছিল। বহু বিধায়ক, পঞ্চায়েত প্রধান ও সামাজিক নেতা এদের মধ্য থেকে উঠে এসেছে। এত সত্ত্বেও কিন্তু, কেবল মুশাহার সমর্থন দিয়েই মাঁজি নির্বাচনে সাফল্যের মুখ দেখতে পাবেন না। তাঁর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। মহাদলিত গোষ্ঠীর সমর্থনের উপর একটি পা রেখে তাঁকে অন্যান্য মধ্যবর্তী বা উচ্চ জাতের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে। সেটা পারলে তবেই সাফল্য ধরা দেবে। দেখা যাক, কোনও নতুন রকম ‘সামাজিক আর জাত সমীকরণ’ তৈরি করতে তিনি সফল হন কি না।

বিহারে জাত-রাজনীতির যুক্তিটা সব সময়ই জটিল। এই যেমন, সাধারণ ভাবে উঁচু জাতের ভোট বিজেপির দিকে গেলেও জেনারেল ক্যাটেগরির কিছু জাত যেমন ব্রাহ্মণদের ভোট কিন্তু বিজেপি আর কংগ্রেসের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়। গত কয়েক দশকে ব্রাহ্মণ, দলিত আর মুসলিমদের মধ্যে কংগ্রেস তার চিরাচরিত সমর্থনটা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। তবু নেই-নেই করেও ব্রাহ্মণরা অনেকেই আজও কংগ্রেসকে পছন্দ করেন। যদি কোনও ভাল ব্রাহ্মণ প্রার্থীর খোঁজ মেলে, কংগ্রেসেরই মুখ উজ্জ্বল হওয়ার সম্ভাবনা। মুসলিমদেরও একই ব্যাপার। কংগ্রেসের ইমেজের যত ক্ষতিই হোক না কেন, তারাই এখনও মুসলমানদের প্রিয়পাত্র। জাত-রাজনীতির সুবাদে একমাত্র বিহারেই হয়তো, আজও কংগ্রেসের পক্ষে ভাল নির্বাচনী ফল করা সম্ভব। অবশ্যই একা নয়, কোনও না কোনও দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে। বাম দলগুলিরও একই অবস্থা। বিভিন্ন নির্বাচনী অঞ্চলে এক-একটি দলের জোর বেশি। দলগুলোর মধ্যে ‘মহা সন্ধি’ হলে প্রত্যেকেরই উপকার হবে।

লক্ষণীয়, গণতান্ত্রিক নির্বাচনের অঙ্কটা তা হলে আমরা কষছি জাতপাতের উপর ভর করেই। বিহারের ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে মজার ব্যাপার। ‘মহা সন্ধি’ যদি জিতে যায়, উন্নয়নের চাহিদা আর গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রসারের দাবি, দুটোই আরও বাড়তে থাকবে, জাতভিত্তিক দাবিগুলি আরও পুষ্ট হবে। কেননা মহা সন্ধি-ও শেষ বিচারে জাতভিত্তিক সন্ধিই বটে। আসল কথা, উন্নয়ন এ রাজ্যে একটা দুমুখো তলোয়ারের মতো। এক দিকে এই তলোয়ার দিয়ে মানুষের ক্রমবর্ধমান আশা-আকাঙ্ক্ষা মেটানোর চেষ্টা চলে, অন্য দিকে এর সাহায্যে আরও বেশি আশা-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হতে থাকে। আর এই দ্বিধাবিভাগের মধ্যে পড়ে জাতপাত-ভিত্তিক আবেগ ক্রমশই আরও জোরদার হয়। নতুন নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা ঘিরে সেই আবেগ নিজেকে সমানে পুষ্ট করে চলে। জাত-আবেগই শেষ পর্যন্ত উন্নয়নের চাহিদা তৈরির মাধ্যমে গণতন্ত্রকে আরও গভীর, আরও প্রসারিত করতে থাকে। সব দলকেই এই হিসেবটা মাথায় রাখতে হয়। বিহারের আসন্ন নির্বাচনেও জাতপাত আর উন্নয়নের এই যুগলবন্দি খেলাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সমীক্ষা চলাকালীন এক ভোজপুরি যুবক মন্তব্য করেছিলেন: নীতীশ কুমার বিহারের উন্নয়নের জন্য অনেক কিছু করেছেন ঠিকই, তবে ভোটের দিন বিহার জাতপাতের হিসেব মেনেই চলবে।

সন্দেহ নেই, নীতীশ কুমার বিহারের অগ্রগতির ইতিহাসে একটা দীর্ঘমেয়াদি অবদান রেখে গিয়েছেন। নীতীশের বিরুদ্ধে যাঁরা ভোট দেবেন, তাঁরাও মনে-প্রাণে জানেন যে, খুব কম নেতাই উন্নয়ন বিষয়টি নীতীশ কুমারের চেয়ে ভাল বোঝেন। আর, যাঁরা নীতীশের পক্ষে ভোট দেবেন, তাঁরা তো এ কথা জানেনই। অথচ যাঁরা নীতীশের পক্ষে, তাঁরাও কিন্তু কেবল ‘উন্নয়ন’ শব্দটা মাথায় রেখেই ভোট দিতে যাবেন না। জাতপাতের অঙ্কটা আগে থেকে মাথায় কষে নিয়ে তবেই বোতামটি টিপবেন।

ইলাহাবাদে জি বি পন্থ সোশ্যাল সায়েন্স ইনস্টিটিউটে সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE