রাজনীতিকদের বিচক্ষণতা অর্ধ বই পূর্ণ দেখিবার সৌভাগ্য ভারতবাসীর বিশেষ হয় না। মেনকা গাঁধীও খণ্ড-বিচক্ষণতার প্রমাণ পেশ করিয়াছেন। গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করাকে আবশ্যিক করিবার প্রস্তাবটির সহিত তিনি সকল গর্ভবতীকে কড়া নজরদারিতে রাখিবার আকাশকুসুমের মিশেল দিলেন। যে দেশে গত দেড় দশকে পঞ্চাশ হাজার আলট্রাসোনোগ্রাফি যন্ত্রের উপর নজর রাখা সম্ভব হয় নাই, সেখানে বৎসরে তিন কোটি গর্ভবতীর খোঁজ রাখিবে সরকার, এমন কথাকে হাস্যকর বলাও বাহুল্য। নজরদারির প্রয়োজনই বা কেন? যে পরিবার কন্যাসন্তান চাহে না, রাষ্ট্র তাহার ঘাড়ে জবরদস্তি সেই সন্তান চাপাইয়া দিলে সন্তানটির পক্ষে তাহার ফল বিষম হওয়াই প্রত্যাশিত। ভ্রূণহত্যা রুখিবার জন্য শিশুকন্যা হত্যার পথটি খুলিয়া দেওয়ার প্রয়োজন নাই। কন্যাসন্তানের প্রাণরক্ষার জন্য আলট্রাসোনোগ্রাফির উপর বিধিনিষেধ চাপানোও অর্থহীন। তাহাতে যদি সত্যই ফল মিলিত, তবে ২০০১ সালের তুলনায় ২০১১ সালে দেশে ছয় বৎসরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে কন্যার অনুপাত হ্রাস পাইত না। যে কোনও নিষেধাজ্ঞারই একমাত্র পরিণাম কালো বাজারের রমরমা। আলট্রাসোনোগ্রাফির ক্ষেত্রেও তাহাই ঘটিয়াছে। নিষেধাজ্ঞায় গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ জানিতে সমস্যা হয় নাই, কিন্তু সেই পরীক্ষা হইতে গর্ভপাত অবধি সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিই কালো বাজারের অন্ধকারে ঢাকা পড়িয়াছে। তাহাতে ক্ষতি যদি কাহারও হয়, তবে তাহা গর্ভবতী মহিলাদের। আর লাভ, বিভিন্ন অদক্ষ চিকিৎসাব্যবসায়ীর, যাহারা এই অন্ধকারে বেসাতি ফাঁদিয়াছে।
এক্ষণে একটি বৃহত্তর দার্শনিক প্রশ্নও আসিয়া পড়ে। কোনও দম্পতি, অথবা কোনও পরিবার, কন্যাসন্তান চাহে কি না, সেই চয়নের অধিকার রাষ্ট্র কাড়িয়া লইতে পারে কি? কোনও সভ্য সমাজে পুত্র ও কন্যার মধ্যে ফারাক থাকিবার কথা নহে। কেহ যদি এই প্রশ্নে স্বেচ্ছায় অ-সভ্য হইতে চাহে, বৃহত্তর সমাজের চক্ষে তাহা কুরুচিকর ঠেকিতে পারে। কিন্তু যত ক্ষণ না কেহ অন্য কাহারও ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাহাকে কন্যভ্রূণ হত্যায় বাধ্য করিতেছে, তত ক্ষণ এই চয়নে বাধা দেওয়ার অধিকার সমাজ বা রাষ্ট্রের নাই। কেহ বলিতেই পারেন, এই সিদ্ধান্তের কুপ্রভাব সমাজের উপর পড়িবে। রাষ্ট্র কন্যাভ্রূণ রক্ষার ব্যবস্থা না করিলে তাহা দীর্ঘমেয়াদে সমাজের লিঙ্গ-ভারসাম্য নষ্ট করিয়া দিবে। এই অতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে এই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করা রাষ্ট্রের অধিকারভুক্ত। ইহা কুযুক্তিমাত্র। বৃহত্তর প্রভাবের যুক্তি খাড়া করিলে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের এক্তিয়ার কার্যত অসীম হইবে। সেই সমাজ ভয়ঙ্কর।
আলোচ্য আইনের ক্ষেত্রে প্রশ্নটি জটিলতর। ভারতে গর্ভপাত নিষিদ্ধ নহে, রাষ্ট্রের আপত্তি শুধু ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণে। অর্থাৎ, আপত্তিটি তথ্য জানাইতে। এই আপত্তিটিকে গ্রাহ্য করিলে আরও বিবিধ তথ্যের ক্ষেত্রে কার্যত একই যুক্তিতে আপত্তি তোলা সম্ভব। রাষ্ট্র হয়তো তাহা তুলিবেও। পথটি গণতন্ত্রের নহে। দেশের লিঙ্গ-ভারসাম্য বজায় রাখা, অথবা কন্যা সন্তানের সুরক্ষায় যদি রাষ্ট্রের আগ্রহ থাকে, তবে তাহার জন্য ভিন্নতর পথ আছে। রাষ্ট্র ঘোষিত ভাবেই মেয়েদের প্রতি পক্ষপাতী হইতে পারে। কন্যাসন্তানের জন্য, এবং কন্যাবিশিষ্ট পরিবারের জন্য বহুবিধ সুবিধার ব্যবস্থা করিতে পারে। বস্তুত, বিভিন্ন রাজ্যে তেমন প্রকল্প চলিতেছেও। অন্য দিকে, ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ আবশ্যক হউক, এবং প্রতিটি গর্ভপাতের তথ্য নথিভুক্ত করাও বাধ্যতামূলক হউক। গর্ভপাতের সিদ্ধান্তে লিঙ্গ-বৈষম্য ঠিক কতখানি প্রভাব ফেলে, তাহার বস্তুনিরপেক্ষ মাপটি পাওয়া যাইবে। তাহার পর না হয় ফের এই তর্ক চলিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy