Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

দিনে খাবারের স্টল, রাতে ডাকাতি

রাস্তা বলতে ফুট ছ’য়েকের মাটির ঢিপি। চারদিকে ধু ধু মাঠ। ছোট চা বাগান, সুপুরি বাগান। সুনসান অন্ধকার। অনেকটা দূর দূর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাড়ি। এর ফাঁকেই ছোট্ট টিনের বাড়ি। গাছের ফাঁক দিয়ে ফুট দু’য়েকের রাস্তা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হয়।

এই গর্তে অপহৃতকে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল।নিজস্ব চিত্র।

এই গর্তে অপহৃতকে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল।নিজস্ব চিত্র।

কৌশিক চৌধুরী
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:৫৫
Share: Save:

রাস্তা বলতে ফুট ছ’য়েকের মাটির ঢিপি। চারদিকে ধু ধু মাঠ। ছোট চা বাগান, সুপুরি বাগান। সুনসান অন্ধকার। অনেকটা দূর দূর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাড়ি। এর ফাঁকেই ছোট্ট টিনের বাড়ি। গাছের ফাঁক দিয়ে ফুট দু’য়েকের রাস্তা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হয়। সামনে মাটির ঢিপি করে খোলা বারান্দা। ঘরের পিছনে প্রায় ১২ ফুটের বিরাট গর্ত। মই দিয়ে নামা-ওঠার ব্যবস্থা। বেড়ার এক কোণে একাধিক মদের খালি বোতল, থার্মোকলের খাবারের পাতা, চিপসের প্যাকেট, গুটকার প্যাকেট, সব্জির খোসা। বেশ কয়েকদিন লোকজন যে অস্থায়ী ভাবে খাওয়া দেওয়া করেছে, তা পরিষ্কার। অনেকটা যেন পিকনিকের মতো করে। ঘরের ভিতরে শুধু একটি চৌকি এবং স্টিলের শো-কেস। তাতে প্লেট, গ্লাস, ব্যাগ। উল্টে পড়ে রয়েছে তোশক।

বৃহস্পতিবার সুনসান দুপুরে মাটিগাড়ার মেচিয়াবস্তির ওই গ্রামে পুলিশ পৌঁছনো অবধি বাড়িটির ধারে কাছে কেউ যায়নি। দূর থেকেই উঁকিঝুকি চলছিল। এই সুনসান এলাকার বাড়িতেই বাংলাদেশের ময়মনসিংহের কাপড়ের ব্যবসায়ী মহম্মদ ইলিয়াসকে অপহরণ করে আটকে রাখা হয়েছিল। এলাকার বাসিন্দা কাঠের পালিস মিস্ত্রি সঞ্জয় চৌধুরী বেশ কিছুদিন আগে জমিটি কিনে টিনের ঘরটি তৈরি করেন। যদিও কেউ তাঁকে কোনওদিনই সেখানে পরিবার নিয়ে সেই ভাবে থাকতে দেখেনি। যেমন দেখেননি।

একসময় ওই জমিটিই ছিল রানি রায়েদের। হলদিবাড়ির এক বাসিন্দাকে তাঁরা বিক্রি করেন। কয়েক হাত ঘুরে তা কেনেন সঞ্জয়। কিন্তু সঞ্জয় যে অপহরণকারী, তা ভেবেই শিউরে উঠছেন রানিদেবী। পুলিশ অফিসারদের দেখে সাহস করে এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি জানান, শ্রমিকের কাজ করেন। তাঁর কথায়, ‘‘দিনের বেলায় বাড়িতেই থাকি না। কয়েকদিন আগে দেখলাম সঞ্জয় কয়েক জনকে নিয়ে বাড়িটির মধ্যে রয়েছে। ঘরের দরজা বন্ধ থাকত। খাওয়া দাওয়া ছাড়া কানে ফোন দিয়েই ছেলেগুলি সব সময় ঘুরত। ওখানে ওর শ্যালক সুশান্তকেও দেখি। তার পরে ভাবি লোকজন এসেছে, তাই হয়তো এখানে রেখেছে। কিন্তু ঘরে, গর্তের মধ্যে আস্ত একটা ছেলেকে আটকে রেখছিল, টেরই পাইনি। কী ভয়ানক।’’

এদিন দুপুরে মাটিগাড়া থানার ওসি দীপাঞ্জন দাসের নেতৃত্বে পুলিশ কর্মীরা গিয়ে ঘরটিকে নতুন করে তল্লাশি করে তালা দিয়ে আসে। এলাকার নগেন বর্মন, ভবেন রায়রা বলেন, ‘‘সঞ্জয়, সুশান্তরা গাড়িধূরার দিকে বড় রাস্তার দিকে থাকে। ছেলেগুলো মিস্ত্রি বলে জানতাম। তবে রং করা চুল, জামাকাপড়, কথাবার্তা শুনে কেমন বখাটে লাগত। তবে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ, মারধর, যৌন নির্যাতন করতে পারে, এতটা ভাবিনি।’’

মাটিগাড়া থানায় ধৃতেরা। নিজস্ব চিত্র।

আবার উত্তররায়ণ উপনগরী লাগোয়া জাতীয় সড়কের পাশে ছোট্ট ঝুপড়ি হোটেলটি ধৃত পঙ্কজ রায়ের। লাগোয়া একটি নার্সিংহোমে আসা লোকজনের জন্য সস্তায় খাবারের দোকান। পালপাড়ার বাসিন্দা পঙ্কজ হোটেলে নিয়মিত যাতায়াতও করত। কিছু দিন ধরে অপরাধ জগতে পঙ্কজ জড়িয়েছে তা পালপাড়ার বনানী রায়, দীপক মোহন্ত বা শেফালি বর্মনেরা লোকমুখে জানতে পেরেছিলেন। তবে তা কী পরিষ্কার ছিল না। ওই বাসিন্দারা জানান, ছেলেটি হোটেল করে বলে জানতাম। কিছু বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাইকে ঘুরত। এক-দু’বার নাকি পুলিশেও ধরেছিল বলে শুনেছি। কিন্তু কী, তা জানতাম না। তবে বাংলাদেশি অপহরণ করে মুক্তিপণ চাওয়ার মতো অপরাধে ছেলেটা হাত পাকিয়েছে, তা শুনে অবাক তাঁরা। একই দশা মাল্লাগুড়ির রুটির হোটেল ব্যবসায়ী অর্জুন শাহের। স্থানীয় দোকানিরা বলেছেন, ‘‘দিনের বেলায় দোকান করত। আবার মাঝে মাঝে দোকান খুলতও না। কিছু ছেলেপিলে আসত দোকানে। আড্ডা হত। কথাবার্তায় ভালই ছিল। বাড়িতে সমস্যার কথা বলত। গত কয়েকদিন দেখাই যাচ্ছিল না। সবাই ভেবেছিল, বাড়ির কাজে ব্যস্ত।’’

পুলিশ অফিসারেরা অবশ্য জানাচ্ছেন, ধৃতেরা মাস তিনেক ধরেই মাটিগাড়য় গতিবিধি বাড়িয়েছিল, তা নানা সূত্রে টের পাওয়া গিয়েছিল। প্রথমে কয়েকটা ছোটখাটো চুরির ঘটনায় নামও জড়ায়। দুই মাস আগে যিশু আশ্রম এলাকা থেকে এক ব্যবসায়ীকে অপহরণের চেষ্টার অভিযোগও উঠেছিল পঙ্কজদের বিরুদ্ধে। পুলিশের তৎপরতায় সেবার পঙ্কজেরা সফল হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে টেলিফোনে কথাবার্তাতেই ধরা পড়ে গেল পঙ্কজরা। সন্দেহের তির যেতেই ধরপাকড় আর তল্লাশি। আর সেখান থেকে উদ্ধার হয় বাংলাদেশি ইলিয়াস। পুলিশ জানিয়েছে, ইলিয়াস তাদের বলেছেন, ব্যবসা, কাজের কথা বলে অভিযুক্তদের হাত ধরে নেপালে গিয়েছিলেন। হিলিতে অভিযুক্তদের এজেন্ট রয়েছে। তেমনই রয়েছে নেপালে। সব জায়গায় নাকি নেটওয়ার্কের লোক রয়েছে। টাকা দিলেই পারাপার, কাজের সব ব্যবস্থা হবে বলেছিল। সেই ফাঁদেই পা দেন ইলিয়াস। তাঁর বক্তব্য, কিন্তু এ ভাবে অপহরণ করে মারধর, যৌন নির্যাতন করে মুক্তিপণের আদায়ের চেষ্টা হবে কথাবার্তায় প্রথমে টেরই পাননি। তিনি জানিয়েছেন, ২০ দিন ধরে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল।

এদিন দুপুরে ধৃত পঙ্কজ রায়, সঞ্জয় চৌধুরী, অর্জুন শাহ, মহম্মদ সাগর, সুশান্ত মাহতকে আদালতে পাঠায় পুলিশ। ইলিয়াসকেও অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে গ্রেফতার করে পেশ করা হলে আদালত ১৫ দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে। শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা বলেছেন, ‘‘তদন্ত চলছে। চক্রের নেটওয়ার্কের খোঁজ চলছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE